বুধবার, ৮ মার্চ, ২০১৭

কুমারী মায়ের আইনি স্বীকৃতি (প্রকাশিত) রাহুল রায়চৌধুরী


কুমারী মায়ের আইনি স্বীকৃতি (প্রকাশিত)
রাহুল রায়চৌধুরী
যাদবপুরে একটা হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে শিক্ষকতা করে রোহিণী (কাল্পনিক), আর বিশাল (কাল্পনিক) ওয়েস্ট বেঙ্গল সিভিল সার্ভিস জয়েন করেছে বছর তিনেক হল । বিশাল বর্ধমান জেলা শাসকের অফিসে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে কর্মরত । ওরা পরস্পরকে ভালবাসে । বাড়ি, অফিস থেকে শুরু করে এলাকার প্রত্যেকেই জানে কিছুদিনের মধ্যেই ওদের বিয়েটা হচ্ছে, তাই ওদের অবাধ মেলামেশায় কেউই কোনদিন কোনও রকম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেনি ।
এ গল্পে কোনও ‘মধুরেণ সমাপয়েৎ’ ঘটেনি । রোহিণী দেখেছে শেষ বছর খানেক সময়ে বিশালের মধ্যে বেশ খানিকটা পরিবর্তন এসেছে । রোহিণী এটাও লক্ষ্য করেছে বিশাল তার প্রতি এইমুহূর্তে খুব কেয়ারিং, প্রেমিক-প্রেমিক, তো পরমুহূর্তেই একদম উদাসীন, অন্য রকম । এ বিষয়ে কথা বলতে চেয়েও কোনও লাভ হয়নি, বিশাল হেসে এড়িয়ে গিয়েছে বিষয়টা । আবার কখনও অজুহাত দেখিয়েছে – অফিসে ভীষণ কাজের চাপ । শেষমেশ যখন পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠল, একদিন উইক এন্ডে মিলেনিয়াম পার্কে দু’জন দু’জনের মুখোমুখি হল । নিজের মধ্যের সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে বিশাল সেদিন ধীরে ধীরে রোহিণীকে জানালো যে বর্ধমান জেলা অফিসে কর্মরতা এক ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে ইতিমধ্যেই ওর একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, এবং পরিস্থিতি বাধ্য করায় দিন সাতেক আগে ওরা রেজিস্ট্রিও করে ফেলেছে ...
সেদিন কোনক্রমে একটা ট্যাক্সি ধরে সারা রাস্তা এক প্রকার কাঁপতে কাঁপতেই বাড়ি ফিরেছিল রোহিণী ।
কিন্তু বিষয়টা জটিলতম হয়ে উঠল, যখন রোহিণী বুঝল যে ইতিমধ্যেই সে অন্তঃসত্ত্বা ...
বিশালের সত্যিটা শোনার পরে বাড়ি থেকে প্রচণ্ড চাপ এল যাতে রোহিণী বিশালের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করে, এবং দ্বিতীয়ত, সময় থাকতেই যেন রোহিণী বাচ্চাটাকে অ্যাবোর্ট করে দেয় ।
একদিকে নিজের জীবন, ভবিষ্যৎ, পারিবারিক/সামাজিক সম্মান, ইত্যাদি ভাবনা, অন্যদিকে নির্দোষ একটা ভ্রূণকে হত্যা করা ... ক্রমশ এক ভাবনা থেকে অন্য ভাবনার আবর্তে পড়ে ছটফট করতে থাকে রোহিণী । কী করা উচিৎ আর কী নয়, সেটাই এক বিরাট প্রশ্নচিহ্ন হয়ে পেন্ডুলামের মত ঝুলতে থাকে রোহিণীর সামনে ।
রোহিণী নিজের সঙ্গে লড়াই করে করে রক্তাক্ত হয় প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে । কিন্তু এভাবে তো চলতে দেওয়া যায় না । রোহিণী প্রত্যেক মুহূর্তে দেখছে ওর সঙ্গে ওর বাড়ির লোকজনও কী দুঃসহ দিন কাটাচ্ছে । আরও কিছুদিন কেটে গেলে এবার রোহিণী মাথা ঠাণ্ডা করে ভাবতে বসে, তার ঠিক কী করা উচিৎ ?
রোহিণী স্বাবলম্বী । রোহিণী ভেবে দেখে এই সমস্ত কিছুর পরেও ওর গর্ভস্থ ভ্রূণটার তো কোনও অপরাধ নেই, তাহলে ও কেন শাস্তি পাবে ? আস্তে আস্তে ও একটা স্থির সিদ্ধান্ত পৌঁছতে চেষ্টা করে । কিছুতেই ‘অ্যাবোর্ট’ করবে না বাচ্চাটাকে । অনাগত এই সন্তানকে পৃথিবীর আলো, বাতাস, খুশি, আনন্দ, কোনও কিছু থেকেই বঞ্চিত করবে না, কিছুতেই না । আর বিশালকেও জানতে দেবে না তার পিতৃপরিচয় । আর এ সবকিছুর জন্য পুরো জীবনে যত লড়াইই ওকে করতে হোক, করবে । এ সন্তান হবে একান্ত ভাবেই ওর একার । রোহিণীর পরিচয়েই এই সন্তান পৃথিবীতে পরিচিত হবে ...
বাচ্চা জন্মের পরে রোহিণী বাচ্চার বার্থ সার্টিফিকেট ইস্যু করবার জন্য, এবং সেই সার্টিফিকেটে তাকেই বাচ্চার মা এবং অভিভাবক হিসাবে লেখার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে নির্ধারিত বয়ানে আবেদন জানালো, যেখানে বাচ্চার পিতার জায়গাটা পেন দিয়ে কেটে দিল । কিন্তু আইনানুযায়ী, বার্থ সার্টিফিকেট ইস্যু করবার জন্য বাচ্চার বাবার নাম, ঠিকানা, ইত্যাদি তথ্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানানো বাধ্যতামূলক । কর্তৃপক্ষ তাই, রোহিণীর কাছে বাচ্চার বাবার নাম, ঠিকানা, ইত্যাদি তথ্য জানতে চাইলো । উত্তরে রোহিণী বলল এ বাচ্চা শুধুমাত্র ওর একার, বাচ্চার কোনও বাবা নেই । রোহিণীর উত্তরে সন্তুষ্ট না হয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ রোহিণীকে জানিয়ে দিল যে বাবার নাম, ঠিকানা, ইত্যাদি তথ্য না জানালে ওরা বাচ্চার বার্থ সার্টিফিকেট ইস্যু করতে পারবে না । উল্টোদিকে, যে বাবা তার বাচ্চার জন্ম বিষয়েই ওয়াকিবহাল নয়, তার কাছে বাচ্চার পিতৃ-পরিচয় দাবি করে রোহিণী কিছুতেই তার বিড়ম্বনার কারণ হতে চাইলো না । আবেদন, নিবেদনে যখন কিছু হল না, রোহিণী তখন বাধ্য হয়ে গার্জেন কোর্টের দ্বারস্থ হল, এবং Guardians and Wards Act, 1890 এর Sec. 7 বলে তাকে ওই বাচ্চার একমাত্র অভিভাবক ডিক্লেয়ার করবার জন্য আবেদন জানালো । উপরোক্ত আইনের Sec. 11 অনুযায়ী বাচ্চার সম্ভাব্য অভিভাবকদের নোটিশ দেওয়া বাধ্যতামূলক । এবার কোর্টও রোহিণীকে বাচ্চার বাবার নাম জানাতে বলল । কিন্তু রোহিণী নিজের সিদ্ধান্তে অবিচল । দ্ব্যর্থহীন ভাষায় রোহিণী কোর্টকে জানালো যে বাচ্চার বাবা এই বাচ্চার জন্ম বিষয়ে কিছুই জানেন না, তাই তার নাম এখানে অদরকারী । আদালতের রায় রোহিণীর বিরুদ্ধে গেল । তার আবেদন খারিজ হয়ে গেল । নাছোড়বান্দা রোহিণী এরপর উচ্চ-আদালতের দ্বারস্থ হল । কিন্তু, সেখানেও ওর আপীল খারিজ হয়ে গেল । শেষমেশ, রোহিণী সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ের দ্বারস্থ হল । ফাইল হল স্পেশাল লিভ পিটিশন ...
এটুকুই ছিল গল্প । এরপর কিন্তু আর কোনও গল্প নেই ...
এরপর এক যুগান্তকারী রায়, ইতিহাস ... দেশের প্রথম সারির দৈনিকগুলোতে বড় বড় হেড লাইনস – ‘কুমারী মায়ের আইনি স্বীকৃতি ... অভিভাবক হতে জরুরী নয় বিয়ে ।’
রোহিণীর মত মা যারা, তাঁদের প্রত্যেকেরই সামাজিক সম্মান ও একক মাতৃত্বের বিষয়টিকে আইনি স্বীকৃতি দিতে অবশেষে পথ দেখালো মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট । SLP (Civil) No. 28367 of 2015 : ABC Vs. The State (NCT of Delhi) মামলায় আপীলটি অ্যালাউ করবার সময় মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট এই মর্মে নির্দেশ জারী করেছেন – ‘The Appeal is, therefore, allowed. The Guardian Court is directed to recall the dismissal order passed by it, and thereafter, consider the Appellant’s application for guardianship expeditiously without requiring notice to be given to the putative father of the child.’
না, মাননীয় সর্বোচ্চ আদালতের আদেশবলে এখন আর গার্জেন কোর্ট রোহিণীর কাছে বাচ্চার পিতৃ-পরিচয় জানতে চাইতে পারে না । বাচ্চাটির সার্বিক কল্যাণের জন্য এবং অবশ্যই বাচ্চাটির জন্ম/উপস্থিতি বিষয়ে ওয়াকিবহাল নয়, এমন একজন ব্যক্তিকে, শ্রেফ নিষেকের জন্য তার স্পার্ম ব্যবহৃত হয়েছে – এই কারণে কোর্টে উপস্থিত হওয়ার নোটিশ পাঠানোর কোনও প্রয়োজন নেই । আমরা আশা করছি, এরপর আর কোনও আইনি প্রতিবন্ধকতা রোহিণীর সামনে আসবে না, এবং এই প্রবন্ধ প্রকাশিত হওয়ার সময় পরিসরে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যাবে, আর রোহিণীও পেয়ে যাবে তার বাচ্চার কাঙ্ক্ষিত ‘অভিভাবকত্ব’ (guardianship) ।
সুপ্রিম কোর্টের আদেশানুসারেই ৬ই জুলাই, ২০১৫র উপরোক্ত আদেশটি All India Reporter (AIR)-এ reportable, অর্থাৎ এমন প্রত্যেকটি মামলার ক্ষেত্রেই দেশের সকল উচ্চ ও নিম্ন আদালতগুলিতে এই আদেশটি প্রদর্শিত (citation) হতে পারে/গ্রাহ্য, এবং এরপর থেকে গার্জেন কোর্ট আর কোনভাবেই আবেদনকারীর কাছে ‘বাচ্চার বাবা কে, বা তার ঠিকানা কী’ জাতীয় তথ্য জানতে চাইতে পারবে না । স্বাভাবিকভাবেই, সকল এই প্রকার মামলার ক্ষেত্রে Guardians and Wards Act, 1890-এর Sec. 11 ধারায় বাচ্চার বাবাকে (natural father) নোটিশ পাঠানো আর বাধ্যতামূলকও রইলো না ।
বাচ্চার অভিভাবকত্ব নির্ণয়ের প্রশ্নে ‘Putative father’কে নোটিশ পাঠাবার আর কোনও প্রয়োজন নেই – এই আদেশটি নিশ্চয়ই আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির কাছে এক যুগান্তকারী পালাবদল । ভারতবর্ষের মত ঘন জনবসতিপূর্ণ দেশে যেখানে পিতৃতন্ত্রের অভিভাবকত্ব থানা গেড়ে বসে রয়েছে মহিলাদের প্রত্যেকটি শ্বাসপ্রশ্বাসের উপরে, যেখানে পুরুষ এবং পুরুষশাসিত সমাজের দাপটে আজও মহিলাদের ‘স্বাভাবিক মানসিক বিকাশ’ ঘটতে পারে না, এবং একটা সময়ের পর থেকে যেখানে মহিলারা তাঁদের স্বাভাবিক চিন্তাশক্তি পর্যন্ত হারিয়ে শুধুমাত্র একজন ‘মেয়েমানুষে’ পর্যবসিত হয়, যেখানে মহিলারাই তাঁদের কন্যা সন্তানকে, শুধুমাত্র সে মেয়ে, এই কারণেই সর্বক্ষণ ভিন্ন ভিন্ন নিষেধের বেড়াজালে বেঁধে ফেলতে চান, যেখানে মেয়েদের শুধুমাত্র সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র হিসাবে গড়ে তোলা হয়, সেখানে সর্বোচ্চ আদালতের এই রায়/আদেশ দেশের কম-বেশি প্রায় সকল মহিলাদের কাছেই খানিকটা হলেও স্বস্তির অক্সিজেন যোগাবে ।
কুমারী মায়ের বাচ্চার অভিভাবকত্বের প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্ট আমাদের রাস্তা দেখিয়েছে ঠিকই, কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট তো আর ভারতীয় গণতন্ত্রের আইনসভা নয়, তাই দেশের পুরনো আইনে নির্দিষ্ট কোনও সংশোধন আনা, কিম্বা দেশবাসীর জন্য নতুন আইন তৈরি করে দেওয়া সুপ্রিম কোর্টের এক্তিয়ারে পড়ে না । দেশের নির্বাচিত সরকারকেই এ বিষয়ে দায়িত্ব নিয়ে পার্লামেন্টে বিল আনতে হবে । পাশ করাতে হবে আইনের নতুন খসড়া । তৈরি করতে হবে মহিলাদের সমানাধিকার প্রশ্নে নতুন আইন ।
তৃতীয় বিশ্বের মহিলাদের মধ্যে শিক্ষার হার বাড়ছে । আজ তারা বুঝতে শিখছে কী তাদের অধিকারের মধ্যে পড়ে, আর কতখানিই বা তাদের এক্তিয়ার । প্রসঙ্গত, আজ মহিলারা যতই শিক্ষিত হচ্ছে, সমাজে মাথা তুলে দাঁড়াতে চাইছে, ততই প্রাসঙ্গিকতা হারাচ্ছে ‘বিবাহ’ নামের সুপ্রাচীন প্রতিষ্ঠানটি । বিবাহ নামক শোষণ যন্ত্রের হাত থেকে অব্যাহতি চাইছে উচ্চ-শিক্ষিত মহিলাদের এক বড় অংশ । একা জীবনের প্রচুর প্রতিবন্ধকতা, ইত্যাদি সত্যিকে মেনে নিয়েও আজ অনেকে মহিলাই একা’র স্বাধীনতাকে বিসর্জন দিতে রাজি নয় । প্রথম বিশ্বের হাওয়া আমাদের তৃতীয় বিশ্বে বইতে শুরু করলে এ দেশের মেয়েরাও বুঝবে একটু ভাল থাকা, সমাজে সম্মানের সঙ্গে মাথা উঁচু করে বাঁচা, ইত্যাদির জন্য আজ সত্যিই পুরুষকে তাদের কোনও প্রয়োজন নেই । তাই এই সময় চিৎকার করে করে বলতে চাইছে - মানবিকতার স্বার্থে, গণতন্ত্রের স্বার্থে আজ মহিলাদের প্রয়োজন নতুন আইন, যেখানে তারা নিজেই নিজেদের জীবনের ছোট, বড় সকল সিদ্ধান্ত নিতে পারবে, নিজের মত করেই জীবন অতিবাহিত করতে পারবে, আর এজন্য তাকে কোনও পুরুষের অনুমতি নিতে হবে না ।
এমন নয় যে আমাদের দেশের প্রত্যেক মানুষ দু’হাত বাড়িয়ে স্বাগত জানাচ্ছেন সুপ্রিম কোর্টের এই রায়কে । অনেক মানুষই আশঙ্কিত । তারা মনে করছেন সুপ্রিম কোর্টের এই রায় দেশের জননৈতিক ভারসাম্যকে বিঘ্নিত করবে । পুরুষের অপরাধ প্রবণতা বাড়বে । পুরুষের আর কোনও দায় থাকবে না তার বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে জন্ম নেওয়া সন্তানকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে, ফলত ‘বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ধর্ষণ’ বাড়বে, বাড়বে লক্ষগুণে ‘কুমারী মাতৃত্ব’ । কুমারী মায়ের বাচ্চাদের জন্য স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, তথা দেশের সমাজ ব্যবস্থায় কিছুটা হলেও শ্রেণিবৈষম্য তৈরি হবে । অনেকেই অভিমত দিচ্ছেন এর ফলে সমাজ ব্যবস্থার মৌলিক কাঠামো ধ্বংস হবে, এবং ভারতবর্ষ মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার দিকে ঝুঁকে পড়বে । যুক্তির বিপরীতেও প্রচুর যুক্তি রয়েছে । কেউ কেউ উদাহরণ দিচ্ছেন ইউরোপ ও আমেরিকার মত উন্নত দেশগুলির, যেখানে বাচ্চার বার্থ সার্টিফিকেট ইস্যু হয় বাচ্চার মায়ের নামই যথেষ্ট, যেখানে বলা হচ্ছে বাচ্চাটিই দেশের সম্পদ, যেখানে বাবার নাম অপশনাল হিসাবে লেখা হয় । সর্বোপরি, ইণ্ডিয়ান পেনাল কোডের ৩৭৬ নং ধারা যতক্ষণ বর্তমান রয়েছে, ততক্ষণ আমরা ‘লক্ষগুণে কুমারী মাতৃত্ব বাড়বে’ বক্তব্যকে আমল নাও দিতে পারি । তাই, সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ের জন্য ‘হায় হায় ! সবকিছু শেষ হয়ে গেল ...’ জাতীয় ভাবনাগুলোকে বস্তায় পুরে বঙ্গোপসাগরে নিক্ষেপ করা যেতেই পারে ।
সময়ের সাপেক্ষে সবকিছুকেই বদলে ফেলতে হয় । এবার পুরুষকেও নিজেকে বদলে নিতে হবে । বদলে ফেলতে হবে মহিলাদের উপর ‘প্রভুত্ব’ করতে চাওয়ার শতাব্দী পুরনো পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতাকে । সমাজ ব্যবস্থায় মহিলাদের সমাধিকারের বিষয়টি বাস্তবিক অর্থেই সর্বজনগ্রাহ্য হতে হবে । পারিবারিক ভিত্তিমূল থেকেই নারী-পুরুষ ভেদাভেদ মুছে ফেলতে হবে । সমাজকে আক্ষরিক অর্থেই বুঝতে হবে প্রতিটি কন্যা সন্তানই রাষ্ট্রের কাছে ঠিক ততখানিই গুরুত্বপূর্ণ, যতখানি একটি পুত্র সন্তান । সমাজকে আরও বুঝতে হবে দেশের মোট জনসংখ্যার ৪৯% মানুষই মহিলা, এবং রাষ্ট্রের ভাগ্য নির্ধারণে এই ৪৯% মানুষ এক বিরাট বড় ফ্যাক্টর, এবং এই মানুষগুলোই আজ দেশের সার্বিক উন্নয়নে পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শ্রম দিচ্ছে, তাই সর্বক্ষেত্রে তাদের সমতার অধিকার আছে ।
এসব আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক চলতেই থাকবে, কেননা সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ের মধ্যে দিয়ে আমাদের দেশের ‘পুরুষতন্ত্র’ আজ কিছুটা হলেও ধাক্কা খেয়েছে । তবুও আমরা চাইবো নারীর সমানাধিকারের প্রশ্নে দেশজুড়ে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ বজায় রেখেই তর্ক-বিতর্ক হোক, আর সেই তর্ক-বিতর্কের মধ্যে দিয়ে উঠে আসুক সামাজিক স্থিতিশীলতা, প্রতিষ্ঠিত হোক সমাজে নারীর সমানাধিকার ।
হয়তো আরও অনেকটা সময় লাগবে আমাদের সমাজে সে স্থিতিশীলতা আসতে, হয়তো ততদিনে গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে যাবে, তবুও আমরা আশাবাদী থাকবো, আমরা চাইব ভারতবর্ষের মহিলারা নিজের জীবন, বেঁচে থাকা, মাতৃত্ব, সমাজ, শিক্ষা, সংস্কৃতিবিষয়ে পুরুষের সমান অধিকার পাক, অধিকার পাক নিজের সন্তানের ‘অভিভাবক’ হওয়ারও, আর তার জন্য যেন তাকে আর কোনদিন এক আদালত থেকে অন্য আদালতে দৌড়তে না হয় .

শুক্রবার, ৩ মার্চ, ২০১৭

নির্মলেন্দু কুণ্ডুর লেখা ক্ষুদ্র গল্প
শিশু
নির্মলেন্দু কুণ্ডু
—"ভারতের পোথ্থম পোধানমন্তি কে জানিস?"
—"ক্যা রে?"
—"রলাল নেহেরু"
—"রলাল,ই আবার ক্যামন নাম রি৷এরম ত শুনি লাই৷"
—"আরে,কাগজখান ওহান থেইক্যে কাটা ছিল৷আগে একটুকুন নাম ছ্যালো৷"
—"ও..জানিস তো,সেদিন এক গপ্প পড়ল্যাম৷ওই মজিদ চাচা বুলছিল না,ও বানিয়ে বুলছে৷দেখলাম,সেই গল্পখান কাগজে ছাপা৷বুড়া মিছে কথা কইছে৷"
—"কস কী রে!"
—"তাইলে আর কইছি কী?ওই,তু ও কী পড়তাছিস রে!"
—"এই কাজগখান দ্যাখ,সেই ছোট্টতে গেরামের ইস্কুলে মাস্টার পইড়েছিল,আমি আর তুই পারিনি বুলে কি সপাং-সপাং বেতের বাড়ি!সেই কবতেখান৷"
—"দেখি দেখি৷হা রে৷তাই তো৷এডা রেখে দে৷পরে পুড়বো৷এই চ,চ৷দেরি কইরলে আবার ওস্তাদ মাইরবে৷"
আবর্জনার স্তূপ থেকে বেরিয়ে এল ন্যাপলা আর মাসুদ৷ওদের পাশ দিয়ে তখন হেঁটে চলেছে স্কুলগামী কিছু সুবেশ শিশু!