সোমবার, ৯ জুলাই, ২০১২


তোমার খাতায় মাইনে কত ?

মাঝবয়সী মহিলা এক দুর্দশা কাতর,
কেহ বলে পাগলী তারে,কেহ ভাবে চোর।
নোংরা,ছেঁড়া শাড়ী পরা,পায়ে ছেঁড়া চটি,
হাতে নিয়ে খাতা কলম,চলেছে পথ হাঁটি।
মাঝে মাঝে হাত তুলে কি বলছে মৃদু স্বরে,
শুনতে পেলেও,সে কথা কেউ বুঝতে নাহি পারে।
শুধাই তারে,কি হয়েছে ?বলে ভীষণ রেগে-
'তোমার খাতায় মাইনে কত ? দেখাও দেখি আগে।'

চমকে উঠি,ঠিক কথা তো,মাইনে আমার কত ?
জন্ম থেকে আজ অবধি কাজ করেছি যত।
ছেলে মেয়ের ভরণপোষণ,পালন পরিবার,
সবার কথাই ভেবে গেলাম,না ভেবে 'আমার'।
বিনিময়ে কি পেয়েছি ? কি বা সার্থকতা ?
করিনি তার হিসাব নিকাশ,বানিয়ে হিসাব খাতা।
জানতে হবে,রহস্য কি - ইচ্ছে মনে জাগে,
বলি তারে,'তোমার খাতা দেখাও দেখি আগে।'

বসিয়ে তারে জল খাবারের দোকানের এক পাশে,
খাতা খুলে বলব কি আর দুঃখে মরি হেসে।
পাতায় পাতায়,হেথায় হোথায় চোখ বুলিয়ে দেখি,
নানা স্থানে নানা বিষয়,চিহ্ন আঁকিবুঁকি।
প্রথম পাতায় নাম লেখা-'শ্রী শ্যামা চরণ রায়',
তাহার হিসাব তিরিশ পাতা,দেখেই বোঝা যায়।
বিয়ের পরের তিরিশ বছর তিরিশ পাতায় ধরা,
জমা-খরচ,দেনা-পাওনা, সেই হিসাবে ভরা।

দয়া,মায়া,ভালবাসা,স্নেহ,আদর আদি,
জমার ঘরে লিখে,পাশে আঁকা কলার কাঁদি।
প্রতি পাতার এক ধারেতে ঢ্যারা চিহ্নের সার,
তলায় লেখা,'প্রতিটি দাগ- প্রতি বারের প্রহার'।
কাপড় কাচা,বাসন মাজা,রান্না করার মাসি,
সে সব খরচ প্রতি পাতায় লেখা রাশি রাশি।
সর্বশেষে হিসাব কষা,গণিকালয়ের ব্যয়,
বলি তারে,না বুঝালে বুঝতে পারা দায়।

সজল চোখে মহিলা কয়,''ভাবছ,পাগল আমি ?
আমি পাগল নই কো মোটে,পাগল পশু স্বামী।
দয়া,মায়া,স্নেহ,আদর ছিল না ওর মনে,
পশুবৃত্তি ছাড়া শ্যামা আর কিছু না জানে।
তিরিশ বছর ওনার ঘরে বেশ্যাগিরির পরে,
যৌবনেতে ভাঁটা দেখে,দিলো যে দূর ক'রে।
ব্যর্থ আমার জীবন বাবু,বিচার কি এর নাই ?
লিখেছি তাই হিসাব খাতায়,পাওনা টাকা চাই।''

প্রতি মাসে ভাত-কাপড়ে হাজার টাকা ধরে,
তিন লক্ষ ষাট হাজার ব্যয় তিরিশ টি বছরে।
দেনা বাবদ আমার নামে দেখুন আছে লেখা,
দয়া,মায়া কাঁচকলা ওর,তাই তো কলা আঁকা।
কাপড় কাচা,বাসন মাজায় তিনশো ধরে মাসে,
এক লক্ষ আট হাজার তো হিসাব মতই আসে।
রান্না করার মাসির বেতন চারশো মাসে হলে,
এক লক্ষ চুয়াল্লিশ হাজার হিসাবেতে মেলে।

গণিকালয়ে দিন-রাত্রি মোট একশো ধরে,
দশ লক্ষ আশি হাজার পাওনা এ সংসারে।
তের লক্ষ বত্রিশ হাজার পাওনা আমার লেখো,
দেনা বাবদ দেয় টাকা,বিয়োগ ক'রে দেখো-
নয় লক্ষ বাহাত্তর হাজার ঠকিয়েছে মোরে,
পতি সাজার সুযোগ পেয়ে,প্রতারণা ক'রে।
সম্পর্ক টা চুকে গেছে,নয় তো সে আর পতি,
তবে কেন মেনে নেব,এমন বিরাট ক্ষতি ?

দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা ক'রে চলে না তো আর,
পাগল বলে ঢিল ছোঁড়ে সব,চালায় অত্যাচার।
এক পশুতে ছেড়ে দেওয়ায়,হাজার পশু ঘোরে,
ইচ্ছে ক'রে পাগল সাজা,ভয় যেন পায় মোরে।
হিসাব খাতা নাও গো বাবু,করো প্রতিকার,
নারীর প্রতি না হয় যেন এমন অবিচার।''
শুনে তাহার সকল ব্যথা,চোখের জলে ভাসি,
পুরুষ জাতির প্রতিনিধি আমি ও সমান দোষী।

ভেবে দেখি,সব পুরুষ ই 'শ্যামা চরণ রায়',
সামান্য তার হের ফেরে তে কি বা আসে যায় ?
নিজের বেলায় হিসাব কষে পূর্ণ ষোলো আনা,
নারী,-সে তো শাস্ত্রমতে বিনা পয়সায় কেনা।
দেহের মোহেই প্রেম-পিরিতি,দেহই ভালবাসা,
দেহই তাদের রঙিন স্বপন,দেহই তাদের নেশা।
চায় নারী কে আপন ক'রে,চায় শুধু তার মন,
এমন পুরুষ পৃথিবীতে আছে বা কয় জন ?

পুরুষ জাতির দম্ভ যাহা,নারীর অপমান,
নারী জাতির বলিদানে,পুরুষ বলীয়ান।
কাপড় কাচা,বাসন মাজা,রান্না,শিশু পালন,
পতির সেবায় জীবন পাত আর পতির সাথে শয়ন।
ঘরে ঘরে নারীর মনে প্রশ্ন যদি জাগে-
'আমার খাতায় মাইনে কত ?হিসাব দেখি আগে।'
বলুন তো সব শ্যামা চরণ,কি দেবেন উত্তর ?
মুখোশ তো আজ খুলে গেছে,তাই কি নিরুত্তর ?

****************************************
সমর কুমার সরকার / শিলিগুড়ি
****************************************

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন