১৭.বর্ষাযাপন
       রাজধানী কলিকাতা;  তেতালার ছাতে 
কাঠের কুঠরি এক ধারে;
আলো আসে পূর্ব দিকে প্রথম প্রভাতে,
বায়ু আসে দক্ষিণের দ্বারে।
কাঠের কুঠরি এক ধারে;
আলো আসে পূর্ব দিকে প্রথম প্রভাতে,
বায়ু আসে দক্ষিণের দ্বারে।
     মেঝেতে বিছানা পাতা,           দুয়ারে রাখিয়া মাথা 
বাহিরে আঁখিরে দিই ছুটি,
সৌধ-ছাদ শত শত ঢাকিয়া রহস্য কত
আকাশেরে করিছে ভ্রূকুটি।
নিকটে জানালা-গায় এক কোণে আলিসায়
একটুকু সবুজের খেলা,
শিশু অশথের গাছ আপন ছায়ার নাচ
সারা দিন দেখিছে একেলা।
দিগন্তের চারি পাশে আষাঢ় নামিয়া আসে,
বর্ষা আসে হইয়া ঘোরালো,
সমস্ত আকাশজোড়া গরজে ইন্দ্রের ঘোড়া
চিকমিকে বিদ্যুতের আলো।
চারি দিকে অবিরল ঝরঝর বৃষ্টিজল
এই ছোটো প্রান্ত-ঘরটিরে
দেয় নির্বাসিত করি দশ দিক অপহরি
সমুদয় বিশ্বের বাহিরে।
বসে বসে সঙ্গীহীন ভালো লাগে কিছুদিন
পড়িবারে মেঘদূতকথা—
বাহিরে দিবস রাতি বায়ু করে মাতামাতি
বহিয়া বিফল ব্যাকুলতা;
বহুপূর্ব আষাঢ়ের মেঘাচ্ছন্ন ভারতের
নগ-নদী-নগরী বাহিয়া
কত শ্রুতিমধু নাম কত দেশ কত গ্রাম
দেখে যাই চাহিয়া চাহিয়া।
ভালো করে দোঁহে চিনি, বিরহী ও বিরহিণী
বাহিরে আঁখিরে দিই ছুটি,
সৌধ-ছাদ শত শত ঢাকিয়া রহস্য কত
আকাশেরে করিছে ভ্রূকুটি।
নিকটে জানালা-গায় এক কোণে আলিসায়
একটুকু সবুজের খেলা,
শিশু অশথের গাছ আপন ছায়ার নাচ
সারা দিন দেখিছে একেলা।
দিগন্তের চারি পাশে আষাঢ় নামিয়া আসে,
বর্ষা আসে হইয়া ঘোরালো,
সমস্ত আকাশজোড়া গরজে ইন্দ্রের ঘোড়া
চিকমিকে বিদ্যুতের আলো।
চারি দিকে অবিরল ঝরঝর বৃষ্টিজল
এই ছোটো প্রান্ত-ঘরটিরে
দেয় নির্বাসিত করি দশ দিক অপহরি
সমুদয় বিশ্বের বাহিরে।
বসে বসে সঙ্গীহীন ভালো লাগে কিছুদিন
পড়িবারে মেঘদূতকথা—
বাহিরে দিবস রাতি বায়ু করে মাতামাতি
বহিয়া বিফল ব্যাকুলতা;
বহুপূর্ব আষাঢ়ের মেঘাচ্ছন্ন ভারতের
নগ-নদী-নগরী বাহিয়া
কত শ্রুতিমধু নাম কত দেশ কত গ্রাম
দেখে যাই চাহিয়া চাহিয়া।
ভালো করে দোঁহে চিনি, বিরহী ও বিরহিণী
সোনার তরী
                    জগতের দু পারে দুজন— 
প্রাণে প্রাণে পড়ে টান, মাঝে মহা ব্যবধান,
মনে মনে কল্পনা সৃজন।
যক্ষবধূ গৃহকোণে ফুল নিয়ে দিন গণে
দেখে শুনে ফিরে আসি চলি।
বর্ষা আসে ঘন রোলে, যত্নে টেনে লই কোলে
গোবিন্দদাসের পদাবলী।
সুর করে বার বার পড়ি বর্ষা-অভিসার—
অন্ধকার যমুনার তীর,
নিশীথে নবীনা রাধা নাহি মানে কোনো বাধা,
খুঁজিতেছে নিকুঞ্জ-কুটির।
অনুক্ষণ দর দর বারি ঝরে ঝর ঝর,
তাহে অতি দূরতর বন;
ঘরে ঘরে রুদ্ধ দ্বার, সঙ্গে কেহ নাহি আর
শুধু এক কিশোর মদন।
প্রাণে প্রাণে পড়ে টান, মাঝে মহা ব্যবধান,
মনে মনে কল্পনা সৃজন।
যক্ষবধূ গৃহকোণে ফুল নিয়ে দিন গণে
দেখে শুনে ফিরে আসি চলি।
বর্ষা আসে ঘন রোলে, যত্নে টেনে লই কোলে
গোবিন্দদাসের পদাবলী।
সুর করে বার বার পড়ি বর্ষা-অভিসার—
অন্ধকার যমুনার তীর,
নিশীথে নবীনা রাধা নাহি মানে কোনো বাধা,
খুঁজিতেছে নিকুঞ্জ-কুটির।
অনুক্ষণ দর দর বারি ঝরে ঝর ঝর,
তাহে অতি দূরতর বন;
ঘরে ঘরে রুদ্ধ দ্বার, সঙ্গে কেহ নাহি আর
শুধু এক কিশোর মদন।
     আষাঢ় হতেছে শেষ,             মিশায়ে মল্লার দেশ 
রচি 'ভরা বাদরের' সুর।
খুলিয়া প্রথম পাতা, গীতগোবিন্দের গাথা
গাহি 'মেঘে অম্বর মেদুর'।
স্তব্ধ রাত্রি দ্বিপ্রহরে ঝুপ্ ঝুপ্ বৃষ্টি পড়ে—
শুয়ে শুয়ে সুখ-অনিদ্রায়
‘রজনী শাঙন ঘন ঘন দেয়া গরজন’
সেই গান মনে পড়ে যায়।
‘পালঙ্কে শয়ান রঙ্গে বিগলিত চীর অঙ্গে’
মনসুখে নিদ্রায় মগন—
সেই ছবি জাগে মনে পুরাতন বৃন্দাবনে
রাধিকার নির্জন স্বপন।
মৃদু মৃদু বহে শ্বাস, অধরে লাগিছে হাস,
কেঁপে উঠে মুদিত পলক;
বাহুতে মাথাটি থুয়ে একাকিনী আছে শুয়ে,
গৃহকোণে ম্লান দীপালোক।
গিরিশিরে মেঘ ডাকে, বৃষ্টি ঝরে তরুশাখে
রচি 'ভরা বাদরের' সুর।
খুলিয়া প্রথম পাতা, গীতগোবিন্দের গাথা
গাহি 'মেঘে অম্বর মেদুর'।
স্তব্ধ রাত্রি দ্বিপ্রহরে ঝুপ্ ঝুপ্ বৃষ্টি পড়ে—
শুয়ে শুয়ে সুখ-অনিদ্রায়
‘রজনী শাঙন ঘন ঘন দেয়া গরজন’
সেই গান মনে পড়ে যায়।
‘পালঙ্কে শয়ান রঙ্গে বিগলিত চীর অঙ্গে’
মনসুখে নিদ্রায় মগন—
সেই ছবি জাগে মনে পুরাতন বৃন্দাবনে
রাধিকার নির্জন স্বপন।
মৃদু মৃদু বহে শ্বাস, অধরে লাগিছে হাস,
কেঁপে উঠে মুদিত পলক;
বাহুতে মাথাটি থুয়ে একাকিনী আছে শুয়ে,
গৃহকোণে ম্লান দীপালোক।
গিরিশিরে মেঘ ডাকে, বৃষ্টি ঝরে তরুশাখে
সোনার তরী
                   দাদুরী ডাকিছে
সারারাতি— 
হেনকালে কী না ঘটে, এ সময়ে আসে বটে
একা ঘরে স্বপনের সাথি।
মরি মরি স্বপ্নশেষে পুলকিত রসাবেশে
যখন সে জাগিল একাকী,
দেখিল বিজন ঘরে দীপ নিবু নিবু করে
প্রহরী প্রহর গেল হাঁকি।
বাড়িছে বৃষ্টির বেগ, থেকে থেকে ডাকে মেঘ,
ঝিল্লিরব পৃথিবী ব্যাপিয়া,
সেই ঘনঘোরা নিশি স্বপ্নে জাগরণে মিশি
না জানি কেমন করে হিয়া।
হেনকালে কী না ঘটে, এ সময়ে আসে বটে
একা ঘরে স্বপনের সাথি।
মরি মরি স্বপ্নশেষে পুলকিত রসাবেশে
যখন সে জাগিল একাকী,
দেখিল বিজন ঘরে দীপ নিবু নিবু করে
প্রহরী প্রহর গেল হাঁকি।
বাড়িছে বৃষ্টির বেগ, থেকে থেকে ডাকে মেঘ,
ঝিল্লিরব পৃথিবী ব্যাপিয়া,
সেই ঘনঘোরা নিশি স্বপ্নে জাগরণে মিশি
না জানি কেমন করে হিয়া।
      লয়ে পুঁথি দু-চারিটি             নেড়ে চেড়ে ইটি সিটি 
এইমতো কাটে দিনরাত।
তার পরে টানি লই বিদেশী কাব্যের বই,
উলটি পালটি দেখি পাত—
কোথা রে বর্ষার ছায়া অন্ধকার মেঘমায়া
ঝরঝর ধ্বনি অহরহ,
কোথায় সে কর্মহীন একান্তে আপনে-লীন
জীবনের নিগূঢ় বিরহ!
বর্ষার সমান সুরে অন্তর বাহির পুরে
সংগীতের মুষলধারায়,
পরানের বহুদূর কূলে কূলে ভরপুর,
বিদেশী কাব্যে সে কোথা হায়!
তখন সে পুঁথি ফেলি, দুয়ারে আসন মেলি
বসি গিয়ে আপনার মনে,
কিছু করিবার নাই চেয়ে চেয়ে ভাবি তাই
দীর্ঘ দিন কাটিবে কেমনে।
মাথাটি করিয়া নিচু বসে বসে রচি কিছু
বহু যত্নে সারাদিন ধরে—
ইচ্ছা করে অবিরত আপনার মনোমত
গল্প লিখি একেকটি করে।
ছোটো প্রাণ, ছোটো ব্যথা, ছোটো ছোটো দুঃখকথা
এইমতো কাটে দিনরাত।
তার পরে টানি লই বিদেশী কাব্যের বই,
উলটি পালটি দেখি পাত—
কোথা রে বর্ষার ছায়া অন্ধকার মেঘমায়া
ঝরঝর ধ্বনি অহরহ,
কোথায় সে কর্মহীন একান্তে আপনে-লীন
জীবনের নিগূঢ় বিরহ!
বর্ষার সমান সুরে অন্তর বাহির পুরে
সংগীতের মুষলধারায়,
পরানের বহুদূর কূলে কূলে ভরপুর,
বিদেশী কাব্যে সে কোথা হায়!
তখন সে পুঁথি ফেলি, দুয়ারে আসন মেলি
বসি গিয়ে আপনার মনে,
কিছু করিবার নাই চেয়ে চেয়ে ভাবি তাই
দীর্ঘ দিন কাটিবে কেমনে।
মাথাটি করিয়া নিচু বসে বসে রচি কিছু
বহু যত্নে সারাদিন ধরে—
ইচ্ছা করে অবিরত আপনার মনোমত
গল্প লিখি একেকটি করে।
ছোটো প্রাণ, ছোটো ব্যথা, ছোটো ছোটো দুঃখকথা
  নিতান্তই সহজ সরল,
সহস্র বিস্মৃতিরাশি প্রত্যহ যেতেছে ভাসি
তারি দু-চারিটি অশ্রুজল।
নাহি বর্ণনার ছটা ঘটনার ঘনঘটা,
নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ।
অন্তরে অতৃপ্তি রবে সাঙ্গ করি’ মনে হবে
শেষ হয়ে হইল না শেষ।
জগতের শত শত অসমাপ্ত কথা যত,
অকালের বিচ্ছিন্ন মুকুল,
অজ্ঞাত জীবনগুলা, অখ্যাত কীর্তির ধুলা,
কত ভাব, কত ভয় ভুল—
সংসারের দশদিশি ঝরিতেছে অহর্নিশি
ঝরঝর বরষার মতো—
ক্ষণ-অশ্রু ক্ষণ-হাসি পড়িতেছে রাশি রাশি
শব্দ তার শুনি অবিরত।
সেই-সব হেলাফেলা, নিমেষের লীলাখেলা
চারি দিকে করি স্তূপাকার,
তাই দিয়ে করি সৃষ্টি একটি বিস্মৃতিবৃষ্টি
জীবনের শ্রাবণনিশার।
সহস্র বিস্মৃতিরাশি প্রত্যহ যেতেছে ভাসি
তারি দু-চারিটি অশ্রুজল।
নাহি বর্ণনার ছটা ঘটনার ঘনঘটা,
নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ।
অন্তরে অতৃপ্তি রবে সাঙ্গ করি’ মনে হবে
শেষ হয়ে হইল না শেষ।
জগতের শত শত অসমাপ্ত কথা যত,
অকালের বিচ্ছিন্ন মুকুল,
অজ্ঞাত জীবনগুলা, অখ্যাত কীর্তির ধুলা,
কত ভাব, কত ভয় ভুল—
সংসারের দশদিশি ঝরিতেছে অহর্নিশি
ঝরঝর বরষার মতো—
ক্ষণ-অশ্রু ক্ষণ-হাসি পড়িতেছে রাশি রাশি
শব্দ তার শুনি অবিরত।
সেই-সব হেলাফেলা, নিমেষের লীলাখেলা
চারি দিকে করি স্তূপাকার,
তাই দিয়ে করি সৃষ্টি একটি বিস্মৃতিবৃষ্টি
জীবনের শ্রাবণনিশার।
  ১৮.বৈষ্ণব
কবিতা
    শুধু বৈকুণ্ঠের তরে
বৈষ্ণবের গান!
    পূর্বরাগ , অনুরাগ , মান-অভিমান ,
    অভিসার , প্রেমলীলা , বিরহ-মিলন ,
    বৃন্দাবনগাথা — এই প্রণয়-স্বপন
    শ্রাবণের শর্বরীতে
কালিন্দীর কূলে ,
    চারি চক্ষে চেয়ে দেখা
কদম্বের মূলে
    শরমে সম্ভ্রমে — এ কি শুধু দেবতার!
    এ সংগীতরসধারা নহে
মিটাবার
    দীন মর্তবাসী এই
নরনারীদের
    প্রতিরজনীর আর
প্রতিদিবসের
    তপ্ত প্রেমতৃষা ?
                 এ গীত-উৎসব-মাঝে
    শুধু তিনি আর ভক্ত
নির্জনে বিরাজে ;
    দাঁড়ায়ে বাহির-দ্বারে
মোরা নরনারী
    উৎসুক শ্রবণ পাতি শুনি
যদি তারি
    দুয়েকটি তান — দূর হতে তাই শুনে
    তরুণ বসন্তে যদি নবীন
ফাল্গুনে
    অন্তর পুলকি উঠে , শুনি সেই সুর
    সহসা দেখিতে পাই
দ্বিগুণ মধুর
    আমাদের ধরা — মধুময় হয়ে উঠে
    আমাদের বনচ্ছায়ে যে
নদীটি ছুটে ,
    মোদের কুটির-প্রান্তে
যে-কদম্ব ফুটে
    বরষার দিনে — সেই প্রেমাতুর তানে
    যদি ফিরে চেয়ে দেখি
মোর পার্শ্ব-পানে
    ধরি মোর বাম বাহু
রয়েছে দাঁড়ায়ে
    ধরার সঙ্গিনী মোর , হৃদয় বাড়ায়ে
    মোর দিকে , বহি নিজ মৌন ভালোবাসা ,
    ওই গানে যদি বা সে পায়
নিজ ভাষা ,
যদি তার মুখে ফুটে পূর্ণ
প্রেমজ্যোতি —
    তোমার কি তাঁর , বন্ধু , তাহে কার ক্ষতি ?
    সত্য করে কহ মোরে হে বৈষ্ণব কবি ,
    কোথা তুমি পেয়েছিলে এই প্রেমচ্ছবি
,
    কোথা তুমি শিখেছিলে এই প্রেমগান
    বিরহ-তাপিত । হেরি কাহার নয়ান ,
    রাধিকার অশ্রু-আঁখি পড়েছিল মনে ?
    বিজন বসন্তরাতে মিলনশয়নে
    কে তোমারে বেঁধেছিল দুটি বাহুডোরে
,
    আপনার হৃদয়ের অগাধ সাগরে
    রেখেছিল মগ্ন করি! এত প্রেমকথা —
    রাধিকার চিত্তদীর্ণ তীব্র
ব্যাকুলতা
    চুরি করি লইয়াছ কার মুখ , কার
    আঁখি হতে! আজ তার নাহি অধিকার
    সে সংগীতে! তারি নারীহৃদয়-সঞ্চিত
    তার ভাষা হতে তারে করিবে বঞ্চিত
    চিরদিন!
                 আমাদেরি কুটির-কাননে
    ফুটে পুষ্প , কেহ দেয়
দেবতা-চরণে ,
    কেহ রাখে প্রিয়জন-তরে — তাহে তাঁর
    নাহি অসন্তোষ । এই প্রেমগীতি হার
    গাঁথা হয় নরনারী-মিলনমেলায় ,
    কেহ দেয় তাঁরে , কেহ বঁধুর গলায় ।
    দেবতারে যাহা দিতে পারি , দিই তাই
    প্রিয়জনে — প্রিয়জনে যাহা
দিতে পাই ,
    তাই দিই দেবতারে ; আর পাব কোথা!
    দেবতারে প্রিয় করি , প্রিয়েরে দেবতা ।
    বৈষ্ণব কবির গাঁথা প্রেম-উপহার
   চলিয়াছে নিশিদিন কত ভারে
ভার
    বৈকুণ্ঠের পথে । মধ্যপথে
নরনারী
    অক্ষয় সে সুধারাশি করি
কাড়াকাড়ি
    লইতেছে আপনার প্রিয়গৃহতরে
    যথাসাধ্য যে যাহার ;
যুগে যুগান্তরে
    চিরদিন পৃথিবীতে
যুবকযুবতী —
    নরনারী এমনি চঞ্চল মতিগতি
।
  দুই পক্ষে মিলে একেবারে
আত্মহারা
    অবোধ অজ্ঞান । সৌন্দর্যের
দস্যু তারা
    লুটেপুটে নিতে চায় সব ।
এত গীতি ,
    এত ছন্দ , এত ভাবে উচ্ছ্বাসিত প্রীতি ,
    এত মধুরতা দ্বারের সম্মুখ
দিয়া
    বহে যায় — তাই তারা পড়েছে আসিয়া
    সবে মিলি কলরবে সেই
সুধাস্রোতে ।
    সমুদ্রবাহিনী সেই
প্রেমধারা হতে
    কলস ভরিয়া তারা লয়ে যায়
তীরে
    বিচার না করি কিছু ,
আপন কুটিরে
    আপনার তরে । তুমি মিছে ধর
দোষ ,
    সে সাধু পণ্ডিত , মিছে করিতেছ রোষ ।
    যাঁর ধন তিনি ওই অপার
সন্তোষে
    অসীম স্নেহের হাসি
হাসিছেন বসে ।
 ১৯.যেতে নাহি
দিব 
          দুয়ারে প্রস্তুত গাড়ি ; বেলা দ্বিপ্রহর ;
হেমন্তের রৌদ্র ক্রমে হতেছে প্রখর ।
জনশূন্য পল্লিপথে ধূলি উড়ে যায়
মধ্যাহ্ন-বাতাসে ; স্নিগ্ধ অশত্থের ছায়
ক্লান্ত বৃদ্ধা ভিখারিণী জীর্ণ বস্ত্র পাতি
ঘুমায়ে পড়েছে ; যেন রৌদ্রময়ী রাতি
ঝাঁ ঝাঁ করে চারি দিকে নিস্তব্ধ নিঃঝুম —
শুধু মোর ঘরে নাহি বিশ্রামের ঘুম ।
গিয়েছে আশ্বিন — পূজার ছুটির শেষে
ফিরে যেতে হবে আজি বহুদূরদেশে
সেই কর্মস্থানে । ভৃত্যগণ ব্যস্ত হয়ে
বাঁধিছে জিনিসপত্র দড়াদড়ি লয়ে ,
হাঁকাহাঁকি ডাকাডাকি এ-ঘরে ও-ঘরে ।
ঘরের গৃহিণী , চক্ষু ছলছল করে ,
ব্যথিছে বক্ষের কাছে পাষাণের ভার ,
তবুও সময় তার নাহি কাঁদিবার
একদণ্ড তরে ; বিদায়ের আয়োজনে
ব্যস্ত হয়ে ফিরে ; যথেষ্ট না হয় মনে
যত বাড়ে বোঝা । আমি বলি , ‘ এ কী কাণ্ড!
এত ঘট এত পট হাঁড়ি সরা ভাণ্ড
বোতল বিছানা বাক্স রাজ্যের বোঝাই
কী করিব লয়ে কিছু এর রেখে যাই
কিছু লই সাথে । '
 
 
সে কথায় কর্ণপাত
নাহি করে কোনো জন । ' কী জানি দৈবাৎ
এটা ওটা আবশ্যক যদি হয় শেষে
তখন কোথায় পাবে বিভুঁই বিদেশে ?
সোনামুগ সরু চাল সুপারি ও পান ;
হেমন্তের রৌদ্র ক্রমে হতেছে প্রখর ।
জনশূন্য পল্লিপথে ধূলি উড়ে যায়
মধ্যাহ্ন-বাতাসে ; স্নিগ্ধ অশত্থের ছায়
ক্লান্ত বৃদ্ধা ভিখারিণী জীর্ণ বস্ত্র পাতি
ঘুমায়ে পড়েছে ; যেন রৌদ্রময়ী রাতি
ঝাঁ ঝাঁ করে চারি দিকে নিস্তব্ধ নিঃঝুম —
শুধু মোর ঘরে নাহি বিশ্রামের ঘুম ।
গিয়েছে আশ্বিন — পূজার ছুটির শেষে
ফিরে যেতে হবে আজি বহুদূরদেশে
সেই কর্মস্থানে । ভৃত্যগণ ব্যস্ত হয়ে
বাঁধিছে জিনিসপত্র দড়াদড়ি লয়ে ,
হাঁকাহাঁকি ডাকাডাকি এ-ঘরে ও-ঘরে ।
ঘরের গৃহিণী , চক্ষু ছলছল করে ,
ব্যথিছে বক্ষের কাছে পাষাণের ভার ,
তবুও সময় তার নাহি কাঁদিবার
একদণ্ড তরে ; বিদায়ের আয়োজনে
ব্যস্ত হয়ে ফিরে ; যথেষ্ট না হয় মনে
যত বাড়ে বোঝা । আমি বলি , ‘ এ কী কাণ্ড!
এত ঘট এত পট হাঁড়ি সরা ভাণ্ড
বোতল বিছানা বাক্স রাজ্যের বোঝাই
কী করিব লয়ে কিছু এর রেখে যাই
কিছু লই সাথে । '
সে কথায় কর্ণপাত
নাহি করে কোনো জন । ' কী জানি দৈবাৎ
এটা ওটা আবশ্যক যদি হয় শেষে
তখন কোথায় পাবে বিভুঁই বিদেশে ?
সোনামুগ সরু চাল সুপারি ও পান ;
       ও হাঁড়িতে ঢাকা আছে
দুই-চারিখান
গুড়ের পাটালি ; কিছু ঝুনা নারিকেল ;
দুই ভাণ্ড ভালো রাই-সরিষার তেল ;
আমসত্ত্ব আমচুর ; সের দুই দুধ —
এই-সব শিশি কৌটা ওষুধবিষুধ ।
মিষ্টান্ন রহিল কিছু হাঁড়ির ভিতরে ,
মাথা খাও , ভুলিয়ো না , খেয়ো মনে করে । '
বুঝিনু যুক্তির কথা বৃথা বাক্যব্যয় ।
বোঝাই হইল উঁচু পর্বতের ন্যায় ।
তাকানু ঘড়ির পানে , তার পরে ফিরে
চাহিনু প্রিয়ার মুখে ; কহিলাম ধীরে ,
‘ তবে আসি ' । অমনি ফিরায়ে মুখখানি
নতশিরে চক্ষু- ' পরে বস্ত্রাঞ্চল টানি
অমঙ্গল অশ্রুজল করিল গোপন ।
 
 
বাহিরে দ্বারের কাছে বসি অন্যমন
কন্যা মোর চারি বছরের । এতক্ষণ
অন্য দিনে হয়ে যেত স্নান সমাপন ,
দুটি অন্ন মুখে না তুলিতে আঁখিপাতা
মুদিয়া আসিত ঘুমে ; আজি তার মাতা
দেখে নাই তারে ; এত বেলা হয়ে যায়
নাই স্নানাহার । এতক্ষণ ছায়াপ্রায়
ফিরিতেছিল সে মোর কাছে কাছে ঘেঁষে ,
চাহিয়া দেখিতেছিল মৌন নির্নিমেষে
বিদায়ের আয়োজন । শ্রান্তদেহে এবে
বাহিরের দ্বারপ্রান্তে কী জানি কী ভেবে
চুপিচাপি বসে ছিল । কহিনু যখন
‘ মা গো , আসি ' সে কহিল বিষণ্ন-নয়ন
ম্লান মুখে , ‘ যেতে আমি দিব না তোমায় । '
যেখানে আছিল বসে রহিল সেথায় ,
ধরিল না বাহু মোর , রুধিল না দ্বার ,
গুড়ের পাটালি ; কিছু ঝুনা নারিকেল ;
দুই ভাণ্ড ভালো রাই-সরিষার তেল ;
আমসত্ত্ব আমচুর ; সের দুই দুধ —
এই-সব শিশি কৌটা ওষুধবিষুধ ।
মিষ্টান্ন রহিল কিছু হাঁড়ির ভিতরে ,
মাথা খাও , ভুলিয়ো না , খেয়ো মনে করে । '
বুঝিনু যুক্তির কথা বৃথা বাক্যব্যয় ।
বোঝাই হইল উঁচু পর্বতের ন্যায় ।
তাকানু ঘড়ির পানে , তার পরে ফিরে
চাহিনু প্রিয়ার মুখে ; কহিলাম ধীরে ,
‘ তবে আসি ' । অমনি ফিরায়ে মুখখানি
নতশিরে চক্ষু- ' পরে বস্ত্রাঞ্চল টানি
অমঙ্গল অশ্রুজল করিল গোপন ।
বাহিরে দ্বারের কাছে বসি অন্যমন
কন্যা মোর চারি বছরের । এতক্ষণ
অন্য দিনে হয়ে যেত স্নান সমাপন ,
দুটি অন্ন মুখে না তুলিতে আঁখিপাতা
মুদিয়া আসিত ঘুমে ; আজি তার মাতা
দেখে নাই তারে ; এত বেলা হয়ে যায়
নাই স্নানাহার । এতক্ষণ ছায়াপ্রায়
ফিরিতেছিল সে মোর কাছে কাছে ঘেঁষে ,
চাহিয়া দেখিতেছিল মৌন নির্নিমেষে
বিদায়ের আয়োজন । শ্রান্তদেহে এবে
বাহিরের দ্বারপ্রান্তে কী জানি কী ভেবে
চুপিচাপি বসে ছিল । কহিনু যখন
‘ মা গো , আসি ' সে কহিল বিষণ্ন-নয়ন
ম্লান মুখে , ‘ যেতে আমি দিব না তোমায় । '
যেখানে আছিল বসে রহিল সেথায় ,
ধরিল না বাহু মোর , রুধিল না দ্বার ,
              শুধু
নিজ হৃদয়ের স্নেহ-অধিকার
প্রচারিল — ‘ যেতে আমি দিব না তোমায় ' ।
তবুও সময় হল শেষ , তবু হায়
যেতে দিতে হল ।
 
 
ওরে মোর মূঢ় মেয়ে ,
কে রে তুই , কোথা হতে কী শকতি পেয়ে
কহিলি এমন কথা , এত স্পর্ধাভরে —
‘ যেতে আমি দিব না তোমায় ' ? চরাচরে
কাহারে রাখিবি ধরে দুটি ছোটো হাতে
গরবিনী , সংগ্রাম করিবি কার সাথে
বসি গৃহদ্বারপ্রান্তে শ্রান্ত ক্ষুদ্র দেহ
শুধু লয়ে ওইটুকু বুকভরা স্নেহ ।
ব্যথিত হৃদয় হতে বহু ভয়ে লাজে
মর্মের প্রার্থনা শুধু ব্যক্ত করা সাজে
এ জগতে , শুধু বলে রাখা ' যেতে দিতে
ইচ্ছা নাহি ' । হেন কথা কে পারে বলিতে
‘ যেতে নাহি দিব ' ! শুনি তোর শিশুমুখে
স্নেহের প্রবল গর্ববাণী , সকৌতুকে
হাসিয়া সংসার টেনে নিয়ে গেল মোরে ,
তুই শুধু পরাভূত চোখে জল ভরে
দুয়ারে রহিলি বসে ছবির মতন ,
আমি দেখে চলে এনু মুছিয়া নয়ন ।
 
 
চলিতে চলিতে পথে হেরি দুই ধারে
শরতের শস্যক্ষেত্র নত শস্যভারে
রৌদ্র পোহাইছে । তরুশ্রেণী উদাসীন
রাজপথপাশে , চেয়ে আছে সারাদিন
আপন ছায়ার পানে । বহে খরবেগ
শরতের ভরা গঙ্গা । শুভ্র খণ্ডমেঘ
প্রচারিল — ‘ যেতে আমি দিব না তোমায় ' ।
তবুও সময় হল শেষ , তবু হায়
যেতে দিতে হল ।
ওরে মোর মূঢ় মেয়ে ,
কে রে তুই , কোথা হতে কী শকতি পেয়ে
কহিলি এমন কথা , এত স্পর্ধাভরে —
‘ যেতে আমি দিব না তোমায় ' ? চরাচরে
কাহারে রাখিবি ধরে দুটি ছোটো হাতে
গরবিনী , সংগ্রাম করিবি কার সাথে
বসি গৃহদ্বারপ্রান্তে শ্রান্ত ক্ষুদ্র দেহ
শুধু লয়ে ওইটুকু বুকভরা স্নেহ ।
ব্যথিত হৃদয় হতে বহু ভয়ে লাজে
মর্মের প্রার্থনা শুধু ব্যক্ত করা সাজে
এ জগতে , শুধু বলে রাখা ' যেতে দিতে
ইচ্ছা নাহি ' । হেন কথা কে পারে বলিতে
‘ যেতে নাহি দিব ' ! শুনি তোর শিশুমুখে
স্নেহের প্রবল গর্ববাণী , সকৌতুকে
হাসিয়া সংসার টেনে নিয়ে গেল মোরে ,
তুই শুধু পরাভূত চোখে জল ভরে
দুয়ারে রহিলি বসে ছবির মতন ,
আমি দেখে চলে এনু মুছিয়া নয়ন ।
চলিতে চলিতে পথে হেরি দুই ধারে
শরতের শস্যক্ষেত্র নত শস্যভারে
রৌদ্র পোহাইছে । তরুশ্রেণী উদাসীন
রাজপথপাশে , চেয়ে আছে সারাদিন
আপন ছায়ার পানে । বহে খরবেগ
শরতের ভরা গঙ্গা । শুভ্র খণ্ডমেঘ
               মাতৃদুগ্ধ
পরিতৃপ্ত সুখনিদ্রারত
সদ্যোজাত সুকুমার গোবৎসের মতো
নীলাম্বরে শুয়ে । দীপ্ত রৌদ্রে অনাবৃত
যুগ-যুগান্তরক্লান্ত দিগন্তবিস্তৃত
ধরণীর পানে চেয়ে ফেলিনু নিশ্বাস ।
 
 
কী গভীর দুঃখে মগ্ন সমস্ত আকাশ ,
সমস্ত পৃথিবী । চলিতেছি যতদূর
শুনিতেছি একমাত্র মর্মান্তিক সুর
‘ যেতে আমি দিব না তোমায় ' । ধরণীর
প্রান্ত হতে নীলাভ্রের সর্বপ্রান্ততীর
ধ্বনিতেছে চিরকাল অনাদ্যন্ত রবে ,
‘ যেতে নাহি দিব । যেতে নাহি দিব । ' সবে
কহে ‘ যেতে নাহি দিব ' । তৃণ ক্ষুদ্র অতি
তারেও বাঁধিয়া বক্ষে মাতা বসুমতী
কহিছেন প্রাণপণে ‘ যেতে নাহি দিব ' ।
আয়ুক্ষীণ দীপমুখে শিখা নিব-নিব ,
আঁধারের গ্রাস হতে কে টানিছে তারে
কহিতেছে শত বার ' যেতে দিব না রে ' ।
এ অনন্ত চরাচরে স্বর্গমর্ত ছেয়ে
সব চেয়ে পুরাতন কথা , সব চেয়ে
গভীর ক্রন্দন — ‘ যেতে নাহি দিব ' । হায় ,
তবু যেতে দিতে হয় , তবু চলে যায় ।
চলিতেছে এমনি অনাদি কাল হতে ।
প্রলয়সমুদ্রবাহী সৃজনের স্রোতে
প্রসারিত-ব্যগ্র-বাহু জ্বলন্ত-আঁখিতে
‘ দিব না দিব না যেতে ' ডাকিতে ডাকিতে
হু হু করে তীব্রবেগে চলে যায় সবে
পূর্ণ করি বিশ্বতট আর্ত কলরবে ।
সম্মুখ-ঊর্মিরে ডাকে পশ্চাতের ঢেউ
সদ্যোজাত সুকুমার গোবৎসের মতো
নীলাম্বরে শুয়ে । দীপ্ত রৌদ্রে অনাবৃত
যুগ-যুগান্তরক্লান্ত দিগন্তবিস্তৃত
ধরণীর পানে চেয়ে ফেলিনু নিশ্বাস ।
কী গভীর দুঃখে মগ্ন সমস্ত আকাশ ,
সমস্ত পৃথিবী । চলিতেছি যতদূর
শুনিতেছি একমাত্র মর্মান্তিক সুর
‘ যেতে আমি দিব না তোমায় ' । ধরণীর
প্রান্ত হতে নীলাভ্রের সর্বপ্রান্ততীর
ধ্বনিতেছে চিরকাল অনাদ্যন্ত রবে ,
‘ যেতে নাহি দিব । যেতে নাহি দিব । ' সবে
কহে ‘ যেতে নাহি দিব ' । তৃণ ক্ষুদ্র অতি
তারেও বাঁধিয়া বক্ষে মাতা বসুমতী
কহিছেন প্রাণপণে ‘ যেতে নাহি দিব ' ।
আয়ুক্ষীণ দীপমুখে শিখা নিব-নিব ,
আঁধারের গ্রাস হতে কে টানিছে তারে
কহিতেছে শত বার ' যেতে দিব না রে ' ।
এ অনন্ত চরাচরে স্বর্গমর্ত ছেয়ে
সব চেয়ে পুরাতন কথা , সব চেয়ে
গভীর ক্রন্দন — ‘ যেতে নাহি দিব ' । হায় ,
তবু যেতে দিতে হয় , তবু চলে যায় ।
চলিতেছে এমনি অনাদি কাল হতে ।
প্রলয়সমুদ্রবাহী সৃজনের স্রোতে
প্রসারিত-ব্যগ্র-বাহু জ্বলন্ত-আঁখিতে
‘ দিব না দিব না যেতে ' ডাকিতে ডাকিতে
হু হু করে তীব্রবেগে চলে যায় সবে
পূর্ণ করি বিশ্বতট আর্ত কলরবে ।
সম্মুখ-ঊর্মিরে ডাকে পশ্চাতের ঢেউ
                 ‘ দিব না দিব না যেতে '
— নাহি শুনে কেউ
নাহি কোনো সাড়া ।
 
চারি দিক হতে আজি
অবিশ্রাম কর্ণে মোর উঠিতেছে বাজি
সেই বিশ্ব-মর্মভেদী করুণ ক্রন্দন
মোর কন্যাকণ্ঠস্বরে ; শিশুর মতন
বিশ্বের অবোধ বাণী । চিরকাল ধরে
যাহা পায় তাই সে হারায় , তবু তো রে
শিথিল হল না মুষ্টি , তবু অবিরত
সেই চারি বৎসরের কন্যাটির মতো
অক্ষুণ্ন প্রেমের গর্বে কহিছে সে ডাকি
‘ যেতে নাহি দিব ' । ম্লান মুখ , অশ্রু-আঁখি ,
দণ্ডে দণ্ডে পলে পলে টুটিছে গরব ,
তবু প্রেম কিছুতে না মানে পরাভব ,
তবু বিদ্রোহের ভাবে রুদ্ধ কণ্ঠে কয়
‘ যেতে নাহি দিব ' । যত বার পরাজয়
তত বার কহে , ‘ আমি ভালোবাসি যারে
সে কি কভু আমা হতে দূরে যেতে পারে ।
আমার আকাঙ্ক্ষা-সম এমন আকুল ,
এমন সকল-বাড়া , এমন অকূল ,
এমন প্রবল বিশ্বে কিছু আছে আর! '
এত বলি দর্পভরে করে সে প্রচার
‘ যেতে নাহি দিব ' । তখনি দেখিতে পায় ,
শুষ্ক তুচ্ছ ধূলি-সম উড়ে চলে যায়
একটি নিশ্বাসে তার আদরের ধন ;
অশ্রুজলে ভেসে যায় দুইটি নয়ন ,
ছিন্নমূল তরু-সম পড়ে পৃথ্বীতলে
হতগর্ব নতশির । তবু প্রেম বলে ,
‘ সত্যভঙ্গ হবে না বিধির । আমি তাঁর
পেয়েছি স্বাক্ষর-দেওয়া মহা অঙ্গীকার
চির-অধিকার-লিপি । ' — তাই স্ফীত বুকে
নাহি কোনো সাড়া ।
চারি দিক হতে আজি
অবিশ্রাম কর্ণে মোর উঠিতেছে বাজি
সেই বিশ্ব-মর্মভেদী করুণ ক্রন্দন
মোর কন্যাকণ্ঠস্বরে ; শিশুর মতন
বিশ্বের অবোধ বাণী । চিরকাল ধরে
যাহা পায় তাই সে হারায় , তবু তো রে
শিথিল হল না মুষ্টি , তবু অবিরত
সেই চারি বৎসরের কন্যাটির মতো
অক্ষুণ্ন প্রেমের গর্বে কহিছে সে ডাকি
‘ যেতে নাহি দিব ' । ম্লান মুখ , অশ্রু-আঁখি ,
দণ্ডে দণ্ডে পলে পলে টুটিছে গরব ,
তবু প্রেম কিছুতে না মানে পরাভব ,
তবু বিদ্রোহের ভাবে রুদ্ধ কণ্ঠে কয়
‘ যেতে নাহি দিব ' । যত বার পরাজয়
তত বার কহে , ‘ আমি ভালোবাসি যারে
সে কি কভু আমা হতে দূরে যেতে পারে ।
আমার আকাঙ্ক্ষা-সম এমন আকুল ,
এমন সকল-বাড়া , এমন অকূল ,
এমন প্রবল বিশ্বে কিছু আছে আর! '
এত বলি দর্পভরে করে সে প্রচার
‘ যেতে নাহি দিব ' । তখনি দেখিতে পায় ,
শুষ্ক তুচ্ছ ধূলি-সম উড়ে চলে যায়
একটি নিশ্বাসে তার আদরের ধন ;
অশ্রুজলে ভেসে যায় দুইটি নয়ন ,
ছিন্নমূল তরু-সম পড়ে পৃথ্বীতলে
হতগর্ব নতশির । তবু প্রেম বলে ,
‘ সত্যভঙ্গ হবে না বিধির । আমি তাঁর
পেয়েছি স্বাক্ষর-দেওয়া মহা অঙ্গীকার
চির-অধিকার-লিপি । ' — তাই স্ফীত বুকে
                   সর্বশক্তি
মরণের মুখের সম্মুখে
দাঁড়াইয়া সুকুমার ক্ষীণ তনুলতা
বলে , ‘ মৃত্যু তুমি নাই । — হেন গর্বকথা!
মৃত্যু হাসে বসি । মরণপীড়িত সেই
চিরজীবী প্রেম আচ্ছন্ন করেছে এই
অনন্ত সংসার , বিষণ্ন নয়ন- ' পরে
অশ্রুবাষ্প-সম , ব্যাকুল আশঙ্কাভরে
চির-কম্পমান । আশাহীন শ্রান্ত আশা
টানিয়া রেখেছে এক বিষাদ-কুয়াশা
বিশ্বময় । আজি যেন পড়িছে নয়নে —
দুখানি অবোধ বাহু বিফল বাঁধনে
জড়ায়ে পড়িয়া আছে নিখিলেরে ঘিরে ,
স্তব্ধ সকাতর । চঞ্চল স্রোতের নীরে
পড়ে আছে একখানি অচঞ্চল ছায়া —
অশ্রুবৃষ্টিভরা কোন্ মেঘের সে মায়া ।
তাই আজি শুনিতেছি তরুরক মর্মরে
এত ব্যাকুলতা ; অলস ঔদাস্যভরে
মধ্যাহ্নের তপ্ত বায়ু মিছে খেলা করে
শুষ্ক পত্র লয়ে ; বেলা ধীরে যায় চলে
ছায়া দীর্ঘতর করি অশত্থের তলে ।
মেঠো সুরে কাঁদে যেন অনন্তের বাঁশি
বিশ্বের প্রান্তর-মাঝে ; শুনিয়া উদাসী
বসুন্ধরা বসিয়া আছেন এলোচুলে
দূরব্যাপী শস্যক্ষেত্রে জাহ্নবীর কূলে
একখানি রৌদ্রপীত হিরণ্য-অঞ্চল
বক্ষে টানি দিয়া ; স্থির নয়নযুগল
দূর নীলাম্বরে মগ্ন ; মুখে নাহি বাণী ।
দেখিলাম তাঁর সেই ম্লান মুখখানি
সেই দ্বারপ্রান্তে লীন , স্তব্ধ মর্মাহত
মোর চারি বৎসরের কন্যাটির মতো ।
দাঁড়াইয়া সুকুমার ক্ষীণ তনুলতা
বলে , ‘ মৃত্যু তুমি নাই । — হেন গর্বকথা!
মৃত্যু হাসে বসি । মরণপীড়িত সেই
চিরজীবী প্রেম আচ্ছন্ন করেছে এই
অনন্ত সংসার , বিষণ্ন নয়ন- ' পরে
অশ্রুবাষ্প-সম , ব্যাকুল আশঙ্কাভরে
চির-কম্পমান । আশাহীন শ্রান্ত আশা
টানিয়া রেখেছে এক বিষাদ-কুয়াশা
বিশ্বময় । আজি যেন পড়িছে নয়নে —
দুখানি অবোধ বাহু বিফল বাঁধনে
জড়ায়ে পড়িয়া আছে নিখিলেরে ঘিরে ,
স্তব্ধ সকাতর । চঞ্চল স্রোতের নীরে
পড়ে আছে একখানি অচঞ্চল ছায়া —
অশ্রুবৃষ্টিভরা কোন্ মেঘের সে মায়া ।
তাই আজি শুনিতেছি তরুরক মর্মরে
এত ব্যাকুলতা ; অলস ঔদাস্যভরে
মধ্যাহ্নের তপ্ত বায়ু মিছে খেলা করে
শুষ্ক পত্র লয়ে ; বেলা ধীরে যায় চলে
ছায়া দীর্ঘতর করি অশত্থের তলে ।
মেঠো সুরে কাঁদে যেন অনন্তের বাঁশি
বিশ্বের প্রান্তর-মাঝে ; শুনিয়া উদাসী
বসুন্ধরা বসিয়া আছেন এলোচুলে
দূরব্যাপী শস্যক্ষেত্রে জাহ্নবীর কূলে
একখানি রৌদ্রপীত হিরণ্য-অঞ্চল
বক্ষে টানি দিয়া ; স্থির নয়নযুগল
দূর নীলাম্বরে মগ্ন ; মুখে নাহি বাণী ।
দেখিলাম তাঁর সেই ম্লান মুখখানি
সেই দ্বারপ্রান্তে লীন , স্তব্ধ মর্মাহত
মোর চারি বৎসরের কন্যাটির মতো ।
 
 
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন