মঙ্গলবার, ৬ আগস্ট, ২০১৩

সোনার তরী * বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর *


   ৯.ব্যর্থ যৌবন
আজি        যে রজনী যায় ফিরাইব তায়
                    কেমনে ?
কেন        নয়নের জল ঝরিছে বিফল
                     নয়নে!
            এ বেশভূষণ লহ সখী , লহ ,
            এ কুসুমমালা হয়েছে অসহ
            এমন যামিনী কাটিল বিরহ
                    শয়নে ।
আজি        যে-রজনী যায় ফিরাইব তায়
                    কেমনে ।


আমি        বৃথা অভিসারে এ যমুনাপারে
                     এসেছি ।
বহি          বৃথা মনোআশা এত ভালোবাসা
                    বেসেছি ।
            শেষে নিশিশেষে বদন মলিন ,
            ক্লান্ত চরণ , মন উদাসীন ,
             ফিরিয়া চলেছি কোন্‌ সুখহীন
                 ভবনে!
হায় ,       যে-রজনী যায় ফিরাইব তায়
                  কেমনে ?


কত         উঠেছিল চাঁদ নিশীথ-অগাধ
                 আকাশে!
বনে          দুলেছিল ফুল গন্ধব্যাকুল
                 বাতাসে ।
            তরুমর্মর নদীকলতান
            কানে লেগেছিল স্বপ্নসমান ,

     ১০.লজ্জা
            আমার হৃদয় প্রাণ
            সকলই করেছি দান ,
       কেবল শরমখানি রেখেছি ।
            চাহিয়া নিজের পানে
            নিশিদিন সাবধানে
       সযতনে আপনারে ঢেকেছি ।


            হে বঁধু , এ স্বচ্ছ বাস
            করে মোরে পরিহাস ,
       সতত রাখিতে নারি ধরিয়া
             চাহিয়া আঁখির কোণে
            তুমি হাস মনে মনে ,
       আমি তাই লাজে যাই মরিয়া ।


            দক্ষিণপবনভরে
            অঞ্চল উড়িয়া পড়ে
       কখন্‌ যে নাহি পারি লখিতে ।
            পুলকব্যাকুল হিয়া
            অঙ্গে উঠে বিকশিয়া ,
       আবার চেতনা হয় চকিতে ।


            বদ্ধ গৃহে করি বাস
            রুদ্ধ যবে হয় শ্বাস
       আধেক বসনবন্ধ খুলিয়া
            বসি গিয়া বাতায়নে ,
            সুখসন্ধ্যাসমীরণে
       ক্ষণতরে আপনারে ভুলিয়া ।
 পূর্ণচন্দ্রকররাশি
            মূর্ছাতুর পড়ে আসি
       এই নবযৌবনের মুকুলে ,
            অঙ্গ মোর ভালোবেসে
            ঢেকে দেয় মৃদু হেসে
       আপনার লাবণ্যের দুকূলে


            মুখে বক্ষে কেশপাশে
            ফিরে বায়ু খেলা-আশে ,
       কুসুমের গন্ধ ভাসে গগনে
            হেনকালে তুমি এলে
            মনে হয় স্বপ্ন ব ' লে ,
        কিছু আর নাহি থাকে স্মরণে ।


            থাক্‌ বঁধু , দাও ছেড়ে ,
            ওটুকু নিয়ো না কেড়ে ,
       এ শরম দাও মোরে রাখিতে
            সকলের অবশেষ
            এইটুকু লাজলেশ
       আপনারে আধখানি ঢাকিতে ।


            ছলছল-দু ' নয়ান
            করিয়ো না অভিমান ,
       আমিও যে কত নিশি কেঁদেছি ;
            বুঝাতে পারি নে যেন
            সব দিয়ে তবু কেন
       সবটুকু লাজ দিয়ে বেঁধেছি


 কেন যে তোমার কাছে
            একটু গোপন আছে ,
একটু রয়েছি মুখ হেলায়ে ।
             এ নহে গো অবিশ্বাস
            নহে সখা , পরিহাস ,
নহে নহে ছলনার খেলা এ ।


       বসন্তনিশীথে বঁধু ,
       লহ গন্ধ , লহ মধু ,
সোহাগে মুখের পানে তাকিয়ো ।
       দিয়ো দোল আশে-পাশে ,
       কোয়ো কথা মৃদু ভাষে
শুধু এর বৃন্তটুকু রাখিয়ো ।


       সেটুকুতে ভর করি
       এমন মাধুরী ধরি
তোমাপানে আছি আমি ফুটিয়া ,
       এমন মোহনভঙ্গে
       আমার সকল অঙ্গে
নবীন লাবণ্য যায় লুটিয়া


       এমন সকল বেলা
       পবনে চঞ্চল খেলা ,
বসন্তকুসুম-মেলা দুধারি ।
       শুন বঁধু , শুন তবে ,
       সকলই তোমার হবে ,
কেবল শরম থাক্‌ আমারি ।


         ১১.মায়াবাদ
হা রে নিরানন্দ দেশ , পরি জীর্ণ জরা ,
বহি বি জ্ঞ তার বোঝা , ভাবিতেছ মনে
ঈশ্বরের প্রবঞ্চনা পড়িয়াছে ধরা
সুচতুর সূক্ষ্মদৃষ্টি তোমার নয়নে!
লয়ে কুশাঙ্কুর বুদ্ধি শাণিত প্রখরা
কর্মহীন রাত্রিদিন বসি গৃহকোণে
মিথ্যা ব ' লে জানিয়াছ বিশ্ববসুন্ধরা
গ্রহতারাময় সৃষ্টি অনন্ত গগনে ।
যুগযুগান্তর ধ ' রে পশু পক্ষী প্রাণী
অচল নির্ভয়ে হেথা নিতেছে নিশ্বাস
বিধাতার জগতেরে মাতৃক্রোড় মানি ;
তুমি বৃদ্ধ কিছুরেই কর না বিশ্বাস!
লক্ষ কোটি জীব লয়ে এ বিশ্বের মেলা
তুমি জানিতেছ মনে , সব ছেলেখেলা ।

  ১২.গতি
জানি আমি সুখে দুঃখে হাসি ও ক্রন্দনে
পরিপূর্ণ এ জীবন , কঠোর বন্ধনে
ক্ষতচিহ্ন পড়ে যায় গ্রনিথতে গ্রনিথতে ,
জানি আমি , সংসারের সমুদ্র মনিথতে
কারো ভাগ্যে সুধা ওঠে , কারো হলাহল ।
জানি না কেন এ সব , কোন্‌ ফলাফল
আছে এই বিশ্বব্যাপী কর্মশৃঙ্খলার ।
জানি না   কী হবে পরে , সবি অন্ধকার
আদি অন্ত এ সংসারে নিখিল দুঃখের
অন্ত আছে কি না আছে , সুখ-বুভুক্ষের
মিটে কি না চির-আশা । পণ্ডিতের দ্বারে
চাহি না এ জনমরহস্য জানিবারে ।
চাহি না ছিঁড়িতে একা বিশ্বব্যাপী ডোর ,
লক্ষ কোটি প্রাণী-সাথে এক গতি মোর 

       ১৩দরিদ্রা
দরিদ্রা বলিয়া তোরে বেশি ভালোবাসি
হে ধরিত্রী , স্নেহ তোর বেশি ভালো লাগে
বেদনাকাতর মুখে সকরুণ হাসি ,
দেখে মোর মর্ম-মাঝে বড়ো ব্যথা জাগে ।
আপনার বক্ষ হতে রসরক্ত নিয়ে
প্রাণটুকু দিয়েছিস সন্তানের দেহে ,
অহর্নিশি মুখে তার আছিস তাকিয়ে ,
অমৃত নারিস দিতে প্রাণপণ স্নেহে ।
কত যুগ হতে তুই বর্ণগন্ধগীতে
সৃজন করিতেছিস আনন্দ-আবাস ,
আজো শেষ নাহি হল দিবসে নিশীথে
স্বর্গ নাই , রচেছিস স্বর্গের আভাস ।
তাই তোর মুখখানি বিষাদকোমল ,
সকল সৌন্দর্যে তোর ভরা অশ্রুজল ।

। ১৪.কণ্টকের কথা
একদা পুলকে প্রভাত-আলোকে
      গাহিছে পাখি ,
কহে কণ্টক বাঁকা কটাক্ষে
      কুসুমে ডাকি
তুমি তো কোমল বিলাসী কমল ,
      দুলায় বায়ু ,
দিনের কিরণ ফুরাতে ফুরাতে
      ফুরায় আয়ু ;
এ পাশে মধুপ মধুমদে ভোর ,
ও পাশে পবন পরিমল-চোর ,
বনের দুলাল , হাসি পায় তোর
      আদর দেখে ।
আহা মরি মরি   কী রঙিন বেশ ,
সোহাগহাসির নাহি আর শেষ ,
সারাবেলা ধরি রসালসাবেশ
গন্ধ মেখে ।
হায় কদিনের আদর-সোহাগ ,
    সাধের খেলা
ললিত মাধুরী , রঙিন বিলাস ,
      মধুপ-মেলা ।

ওগো নহি আমি তোদের মতন
      সুখের প্রাণী
হাব ভাব হাস , নানারঙা বাস
      নাহিকো জানি ।
রয়েছি নগ্ন , জগতে লগ্ন
      আপন বলে ;
কে পারে তাড়াতে , আমারে মাড়াতে
      ধরণীতলে ।
তোদের মতন নহি নিমেষের ,

আমি এ নিখিলে চিরদিবসের ,
বৃষ্টি-বাদল ঝড়-বাতাসের
      না রাখি ভয় ।
সতত একাকী , সঙ্গীবিহীন
কারো কাছে কোনো নাহি প্রেম-ঋণ ,
চাটুগান শুনি সারা নিশিদিন
      করি না ক্ষয় ।
আসিবে তো শীত , বিহঙ্গগীত
      যাইবে থামি ,
ফুলপল্লব ঝরে যাবে সব
      রহিব আমি ।

চেয়ে দেখো মোরে , কোনো বাহুল্য
      কোথাও নাই ,
স্পষ্ট সকলি      আমার মূল্য
      জানে সবাই ।
এ ভীরু জগতে যার কাঠিন্য
      জগৎ তারি ।
নখের আঁচড়ে আপন চিহ্ন
      রাখিতে পারি ।
কেহ জগতেরে চামর ঢুলায় ,
চরণে কোমল হস্ত বুলায় ,
নতমস্তকে লুটায়ে ধুলায়
      প্রণাম করে ।
ভুলাইতে মন কত করে ছল
কাহারো বর্ণ , কারো পরিমল ,
বিফল বাসরসজ্জা , কেবল
      দুদিন-তরে ।
কিছুই করি না , নীরবে দাঁড়ায়ে
      তুলিয়া শির
বিঁধিয়া রয়েছি অন্তর-মাঝে
      এ পৃথিবীর ।


'আমারে তোমরা চাহ না চাহিতে
      চোখের কোণে ,
গরবে ফাটিয়া উঠেছ ফুটিয়া
      আপন মনে ।
আছে তব মধু , থাক্‌ সে তোমার
      আমার নাহি ।
আছে তব রূপ     মোর পানে কেহ
      দেখে না চাহি ।
কারো আছে শাখা , কারো আছে দল ,
কারো আছে ফুল , কারো আছে ফল ,
আমারি হস্ত রিক্ত কেবল
     দিবসযামী ।
ওহে তরু , তুমি বৃহৎ প্রবীণ ,
আমাদের প্রতি অতি উদাসীন
আমি বড়ো নহি , আমি ছায়াহীন ,
    ক্ষুদ্র আমি ।
হই না ক্ষুদ্র , তবুও রুদ্র
    ভীষণ ভয়
আমার দৈন্য সে মোর সৈন্য ,
    তাহারি জয় ।'


 ১৫.শৈশবসন্ধ্যা
ধীরে ধীরে বিস্তারিছে ঘেরি চারিধার 
শ্রান্তি, আর শান্তি, আর সন্ধ্যা-অন্ধকার,
মায়ের অঞ্চলসম। দাঁড়ায়ে একাকী 
মেলিয়া পশ্চিম-পানে অনিমেষ আঁখি 
স্তব্ধ চেয়ে আছি। আপনারে মগ্ন করি 
অতলের তলে, ধীরে লইতেছি ভরি 
জীবনের মাঝেআজিকার এই ছবি,
জনশূন্য নদীতীর, অস্তমান রবি,
ম্লান মূর্ছাতুর আলোরোদন-অরুণ,
ক্লান্ত নয়নের যেন দৃষ্টি সকরুণ 
স্থির বাক্যহীনএই গভীর বিষাদ,
জলে স্থলে চরাচরে শ্রান্তি অবসাদ। 
সহসা উঠিল গাহি কোন্‌খান হতে 
বন-অন্ধকারঘন কোন্‌ গ্রামপথে 
যেতে যেতে গৃহমুখে বালক-পথিক। 
উচ্ছ্বসিত কণ্ঠস্বর নিশ্চিন্ত নির্ভীক 
কাঁপিছে সপ্তম সুরে, তীব্র উচ্চতান 
সন্ধ্যারে কাটিয়া যেন করিবে দুখান। 
দেখিতে না পাই তারে। ওই যে সম্মুখে 
প্রান্তরের সর্বপ্রান্তে, দক্ষিণের মুখে,
আখের খেতের পারে, কদলী সুপারি 
নিবিড় বাঁশের বন, মাঝখানে তারি 
বিশ্রাম করিছে গ্রাম, হোথা আঁখি ধায়। 
হোথা কোন্‌ গৃহপানে গেয়ে চলে যায় 
কোন্‌ রাখালের ছেলে, নাহি ভাবে কিছু,
নাহি চায় শূন্যপানে, নাহি আগুপিছু।

দেখে শুনে মনে পড়ে সেই সন্ধ্যাবেলা 
শৈশবের। কত গল্প, কত বাল্যখেলা,
এক বিছানায় শুয়ে মোরা সঙ্গী তিন;
সে কি আজিকার কথা, হল কত দিন। 
এখনো কি বৃদ্ধ হয়ে যায় নি সংসার। 
ভোলে নাই খেলাধুলা, নয়নে তাহার 
আসে নাই নিদ্রাবেশ শান্ত সুশীতল,
বাল্যের খেলানাগুলি করিয়া বদল 
পায় নি কঠিন জ্ঞান? দাঁড়ায়ে হেথায় 
নির্জন মাঠের মাঝে, নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়,
শুনিয়া কাহার গান পড়ি গেল মনে 
কত শত নদীতীরে, কত আম্রবনে,
কাংস্যঘণ্টা-মুখরিত মন্দিরের ধারে,
কত শস্যক্ষেত্রপ্রান্তে, পুকুরের পাড়ে 
গৃহে গৃহে জাগিতেছে নব হাসিমুখ,
নবীন হৃদয়ভরা নব নব সুখ,
কত অসম্ভব কথা, অপূর্ব কল্পনা,
কত অমূলক আশা, অশেষ কামনা,
অনন্ত বিশ্বাস। দাঁড়াইয়া অন্ধকারে 
দেখিনু নক্ষত্রালোকে, অসীম সংসারে 
রয়েছে পৃথিবী ভরি বালিকা বালক,
সন্ধ্যাশয্যা, মার মুখ, দীপের আলোক।

   ১৬.সুপ্তোত্থিতা 
        ঘুমের দেশে ভাঙিল ঘুম,
             উঠিল কলস্বর। 
        গাছের শাখে জাগিল পাখি 
             কুসুমে মধুকর।  
       অশ্বশালে জাগিল ঘোড়া,
            হস্তিশালে হাতি। 
        মল্লশালে মল্ল জাগি 
            ফুলায় পুন ছাতি। 
        জাগিল পথে প্রহরিদল,
            দুয়ারে জাগে দ্বারী। 
        আকাশে চেয়ে নিরখে বেলা 
             জাগিয়া নরনারী। 
        উঠিল জাগি রাজাধিরাজ,
            জাগিল রানীমাতা। 
        কচালি আঁখি কুমার-সাথে 
            জাগিল রাজভ্রাতা। 
        নিভৃত ঘরে ধূপের বাস,
            রতন-দীপ জ্বালা,
        জাগিয়া উঠি শয্যাতলে 
           শুধাল রাজবালা 
                কে পরালে মালা!

        খসিয়া-পড়া আঁচলখানি 
            বক্ষে তুলি দিল। 
        আপন-পানে নেহারি চেয়ে 
            শরমে শিহরিল। 
        ত্রস্ত হয়ে চকিত চোখে 
            চাহিল চারিদিকে,
        বিজন গৃহ, রতন-দীপ 
            জ্বলিছে অনিমিখে। 

 গলার মালা খুলিয়া লয়ে 
            ধরিয়া দুটি করে  
     সোনার সুতে যতনে গাঁথা 
            লিখনখানি পড়ে। 
        পড়িল নাম, পড়িল ধাম,
            পড়িল লিপি তার,
        কোলের পরে বিছায়ে দিয়ে 
            পড়িল শতবার। 
        শয়নশেষে রহিল বসে,
            ভাবিল রাজবালা 
        আপন ঘরে ঘুমায়েছিনু 
            নিতান্ত নিরালা 
                  কে পরালে মালা!

        নূতন-জাগা কুঞ্জবনে 
            কুহরি উঠে পিক,
        বসন্তের চুম্বনেতে 
            বিবশ দশ দিক। 
       বাতাস ঘরে প্রবেশ করে 
            ব্যাকুল উচ্ছ্বাসে,
        নবীন ফুলমঞ্জরির 
            গন্ধ লয়ে আসে। 
        জাগিয়া উঠি বৈতালিক 
            গাহিছে জয়গান,
        প্রাসাদদ্বারে ললিত স্বরে 
            বাঁশিতে উঠে তান। 
        শীতলছায়া নদীর পথে 
            কলসে লয়ে বারি 
        কাঁকন বাজে, নূপুর বাজে 
            চলিছে পুরনারী। 
        কাননপথে মর্মরিয়া 
            কাঁপিছে গাছপালা,
 আধেক মুদি নয়ন দুটি 
             ভাবিছে রাজবালা 
                 কে পরালে মালা!

        বারেক মালা গলায় পরে,
              বারেক লহে খুলি,
        দুইটি করে চাপিয়া ধরে 
             বুকের কাছে তুলি। 
        শয়নপরে মেলায়ে দিয়ে 
             তৃষিত চেয়ে রয়,
        এমনি করে পাইবে যেন 
             অধিক পরিচয়। 
        জগতে আজ কত-না ধ্বনি 
             উঠিছে কত ছলে 
        একটি আছে গোপন কথা,
              সে কেহ নাহি বলে। 
        বাতাস শুধু কানের কাছে 
               বহিয়া যায় হূহু,
        কোকিল শুধু অবিশ্রাম 
               ডাকিছে কুহু কুহু। 
        নিভৃত ঘরে পরান-মন 
               একান্ত উতালা,
        শয়নশেষে নীরবে বসে 
               ভাবিছে রাজবালা 
                    কে পরালে মালা!

        কেমন বীর-মুরতি তার 
             মাধুরী দিয়ে মিশা। 
        দীপ্তিভরা নয়নমাঝে 
             তৃপ্তিহীন তৃষা। 
        স্বপ্নে তারে দেখেছে যেন 
            এমনি মনে লয় 
ভুলিয়া গেছে, রয়েছে শুধু 
             অসীম বিস্ময়। 
        পারশে যেন বসিয়াছিল,
             ধরিয়াছিল কর,
        এখনো তার পরশে যেন 
             সরস কলেবর। 
        চমকি মুখ দু-হাতে ঢাকে,
             শরমে টুটে মন,
        লজ্জাহীন প্রদীপ কেন 
             নিভে নি সেই ক্ষণ। 
        কণ্ঠ হতে ফেলিল হার 
              যেন বিজুলিজ্বালা,
        শয়নপরে লুটায়ে পড়ে 
              ভাবিল রাজবালা
                  কে পরালে মালা!

        এমনি ধীরে একটি করে
           কাটিছে দিন রাতি।
        বসন্ত সে বিদায় নিল
            লইয়া যূথী-জাতি।
        সঘন মেঘে বরষা আসে,
             বরষে ঝরঝর্‌।
        কাননে ফুটে নবমালতী
             কদম্বকেশর।
        স্বচ্ছ হাসি শরৎ আসে
             পূর্ণিমামালিকা।
        সকল বন আকুল করে
             শুভ্র শেফালিকা।
        আসিল শীত সঙ্গে লয়ে
             দীর্ঘ দুখনিশা।
        শিশির-ঝরা কুন্দফুলে
             হাসিয়া কাঁদে দিশা। 
 ফাগুন মাস আবার এল 
            বহিয়া ফুলডালা। 
        জানালা-পাশে একেলা বসে 
             ভাবিছে রাজবালা 
                  কে পরালে মালা!





কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন