*সোনার তরী *
*রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর** 
১. বিম্ববতী
  রূপকথা
   সযত্নে সাজিল রানী, বাঁধিল কবরী,
নবঘনস্নিগ্ধবর্ণ নব নীলাম্বরী
পরিল অনেক সাধে। তার পরে ধীরে
গুপ্ত আবরণ খুলি আনিল বাহিরে
মায়াময় কনকদর্পণ। মন্ত্র পড়ি
শুধাইল তারে— কহ মোরে সত্য করি
সর্বশ্রেষ্ঠ রূপসী কে ধরায় বিরাজে।
ফুটিয়া উঠিল ধীরে মুকুরের মাঝে
মধুমাখা হাসি-আঁকা একখানি মুখ,
দেখিয়া বিদারি গেল মহিষীর বুক—
রাজকন্যা বিম্ববতী সতিনের মেয়ে,
ধরাতলে রূপসী সে সবাকার চেয়ে।
নবঘনস্নিগ্ধবর্ণ নব নীলাম্বরী
পরিল অনেক সাধে। তার পরে ধীরে
গুপ্ত আবরণ খুলি আনিল বাহিরে
মায়াময় কনকদর্পণ। মন্ত্র পড়ি
শুধাইল তারে— কহ মোরে সত্য করি
সর্বশ্রেষ্ঠ রূপসী কে ধরায় বিরাজে।
ফুটিয়া উঠিল ধীরে মুকুরের মাঝে
মধুমাখা হাসি-আঁকা একখানি মুখ,
দেখিয়া বিদারি গেল মহিষীর বুক—
রাজকন্যা বিম্ববতী সতিনের মেয়ে,
ধরাতলে রূপসী সে সবাকার চেয়ে।
   তার পরদিন রানী প্রবালের হার 
পরিল গলায়। খুলি দিল কেশভার
আজানুচুম্বিত। গোলাপি অঞ্চলখানি,
লজ্জার আভাস-সম, বক্ষে দিল টানি।
সুবর্ণমুকুর রাখি কোলের উপরে
শুধাইল মন্ত্র পড়ি— কহ সত্য করে
ধরামাঝে সব চেয়ে কে আজি রূপসী।
দর্পণে উঠিল ফুটে সেই মুখশশী।
কাঁপিয়া কহিল রানী, অগ্নিসম জ্বালা—
পরালেম তারে আমি বিষফুলমালা,
তবু মরিল না জ্বলে সতিনের মেয়ে,
ধরাতলে রূপসী সে সকলের চেয়ে!
পরিল গলায়। খুলি দিল কেশভার
আজানুচুম্বিত। গোলাপি অঞ্চলখানি,
লজ্জার আভাস-সম, বক্ষে দিল টানি।
সুবর্ণমুকুর রাখি কোলের উপরে
শুধাইল মন্ত্র পড়ি— কহ সত্য করে
ধরামাঝে সব চেয়ে কে আজি রূপসী।
দর্পণে উঠিল ফুটে সেই মুখশশী।
কাঁপিয়া কহিল রানী, অগ্নিসম জ্বালা—
পরালেম তারে আমি বিষফুলমালা,
তবু মরিল না জ্বলে সতিনের মেয়ে,
ধরাতলে রূপসী সে সকলের চেয়ে!
   তার পরদিনে— আবার রুধিল দ্বার 
শয়নমন্দিরে। পরিল মুক্তার হার,
শয়নমন্দিরে। পরিল মুক্তার হার,
২. নিদ্রিতা
রাজার ছেলে ফিরেছি দেশে দেশে
    সাত সমুদ্র তেরো নদীর পার।
যেখানে যত মধুর মুখ আছে
    বাকি তো কিছু রাখি নি দেখিবার।
কেহ বা ডেকে কয়েছে দুটো কথা,
    কেহ বা চেয়ে করেছে আঁখি নত,
কাহারো হাসি ছুরির মতো কাটে
    কাহারো হাসি আঁখিজলেরই মতো।
গরবে কেহ গিয়েছে নিজ ঘর,
    কাঁদিয়া কেহ চেয়েছে ফিরে ফিরে।
কেহ বা কারে কহে নি কোনো কথা,
    কেহ বা গান গেয়েছে ধীরে ধীরে।
এমনি করে ফিরেছি দেশে দেশে।
    অনেক দূরে তেপান্তর-শেষে
ঘুমের দেশে ঘুমায় রাজবালা,
    তাহারি গলে এসেছি দিয়ে মালা।
একদা রাতে নবীন যৌবনে
   স্বপ্ন হতে উঠিনু চমকিয়া,
বাহিরে এসে দাঁড়ানু একবার
    ধরার পানে দেখিনু নিরখিয়া।
শীর্ণ হয়ে এসেছে শুকতারা,
    পূর্বতটে হতেছে নিশি ভোর।
আকাশ-কোণে বিকাশে জাগরণ,
   ধরণীতলে ভাঙে নি ঘুমঘোর।
সমুখে পড়ে দীর্ঘ রাজপথ,
   দু-ধারে তারি দাঁড়ায়ে তরুসার,
নয়ন মেলি সুদূর-পানে চেয়ে
    আপন মনে ভাবিনু একবার—
আমারি মতো আজি এ নিশিশেষে
৩.সোনার বাঁধন
 বন্দী হয়ে আছ তুমি সুমধুর স্নেহে 
অয়ি গৃহলক্ষ্মী, এই করুণক্রন্দন
এই দুঃখদৈন্যে-ভরা মানবের গেহে।
তাই দুটি বাহু’পরে সুন্দরবন্ধন
সোনার কঙ্কণ দুটি বহিতেছে দেহে
শুভচিহ্ন, নিখিলের নয়ননন্দন।
পুরুষের দুই বাহু কিণাঙ্ক-কঠিন
সংসারসংগ্রামে, সদা বন্ধনবিহীন;
যুন্ধ-দ্বন্দ্ব যত কিছু নিদারুণ কাজে
বহ্নিবাণ বজ্রসম সর্বত্র স্বাধীন।
তুমি বদ্ধ স্নেহ-প্রেম-করুণার মাঝে—
শুধু শুভকর্ম, শুধু সেবা নিশিদিন।
তোমার বাহুতে তাই কে দিয়াছে টানি,
দুইটি সোনার গণ্ডি, কাঁকন দুখান
অয়ি গৃহলক্ষ্মী, এই করুণক্রন্দন
এই দুঃখদৈন্যে-ভরা মানবের গেহে।
তাই দুটি বাহু’পরে সুন্দরবন্ধন
সোনার কঙ্কণ দুটি বহিতেছে দেহে
শুভচিহ্ন, নিখিলের নয়ননন্দন।
পুরুষের দুই বাহু কিণাঙ্ক-কঠিন
সংসারসংগ্রামে, সদা বন্ধনবিহীন;
যুন্ধ-দ্বন্দ্ব যত কিছু নিদারুণ কাজে
বহ্নিবাণ বজ্রসম সর্বত্র স্বাধীন।
তুমি বদ্ধ স্নেহ-প্রেম-করুণার মাঝে—
শুধু শুভকর্ম, শুধু সেবা নিশিদিন।
তোমার বাহুতে তাই কে দিয়াছে টানি,
দুইটি সোনার গণ্ডি, কাঁকন দুখান
৪. পরশপাথর 
           খ্যাপা খুঁজে খুঁজে ফিরে পরশপাথর ।
   মাথায় বৃহৎ জটা                  ধুলায় কাদায় কটা ,
        মলিন ছায়ার মতো ক্ষীণ
কলেবর ।
   ওষ্ঠে অধরেতে চাপি             অন্তরের দ্বার ঝাঁপি
        রাত্রিদিন তীব্র
জ্বালা জ্বেলে রাখে চোখে ।
   দুটো নেত্র সদা যেন               নিশার খদ্যোত-হেন
        উড়ে উড়ে খোঁজে কারে
নিজের আলোকে ।
   নাহি যার চালচুলা             গায়ে মাখে ছাইধুলা
        কটিতে জড়ানো শুধু ধূসর
কৌপীন ,
   ডেকে কথা কয় তারে         কেহ নাই এ সংসারে
        পথের ভিখারি হতে আরো
দীনহীন ,
   তার এত অভিমান ,              সোনারুপা তুচ্ছজ্ঞান ,
        রাজসম্পদের লাগি নহে
সে কাতর ,
   দশা দেখে হাসি পায়           আর কিছু নাহি চায়
        একেবারে পেতে চায়
পরশপাথর!
        সম্মুখে গরজে সিন্ধু
অগাধ অপার ।
   তরঙ্গে তরঙ্গ উঠি               হেসে হল কুটিকুটি
        সৃষ্টিছাড়া পাগলের
দেখিয়া ব্যাপার ।
আকাশ রয়েছে চাহি ,            নয়নে নিমেষ নাহি ,
        হু হু করে সমীরণ
ছুটেছে অবাধ ।
সূর্য ওঠে প্রাতঃকালে            পূর্ব গগনের ভালে ,
        সন্ধ্যাবেলা ধীরে ধীরে
উঠে আসে চাঁদ ।
জলরাশি অবিরল                  করিতেছে কলকল ,
        অতল রহস্য যেন চাহে
বলিবারে ।
কাম্য ধন আছে কোথা         জানে যেন সব কথা ,
        সে-ভাষা যে বোঝে সেই
খুঁজে নিতে পারে ।
কিছুতে ভ্রূক্ষেপ নাহি ,         মহা গাথা গান গাহি
        সমুদ্র আপনি শুনে
আপনার স্বর ।
    ৫.আকাশের
চাঁদ 
          হাতে তুলে দাও আকাশের
চাঁদ —
                এই হল তার বুলি ।
         দিবস রজনী যেতেছে
বহিয়া ,
                কাঁদে সে দু হাত তুলি
।
         হাসিছে আকাশ , বহিছে বাতাস ,
                পাখিরা গাহিছে সুখে ।
         সকালে রাখাল চলিয়াছে
মাঠে ,
                বিকালে ঘরের মুখে ।
         বালক বালিকা ভাই বোনে
মিলে
                খেলিছে আঙিনা-কোণে ,
         কোলের শিশুরে হেরিয়া
জননী
                হাসিছে আপন মনে ।
           কেহ হাটে যায় কেহ বাটে
যায়
                চলেছে যে যার কাজে —
         কত জনরব কত কলরব
                উঠিছে আকাশমাঝে ।
         পথিকেরা এসে তাহারে
শুধায় ,
               ‘ কে
তুমি কাঁদিছ বসি । '
         সে কেবল বলে নয়নের জলে
,
               ‘ হাতে
পাই নাই শশী । '
        সকালে বিকালে ঝরি পড়ে
কোলে
                অযাচিত ফুলদল ,
          দখিন সমীর বুলায় ললাটে
                দক্ষিণ করতল ।
         প্রভাতের আলো আশিস-পরশ
                করিছে তাহার দেহে ,
         রজনী তাহারে বুকের
আঁচলে
     ৬.প্রতীক্ষা
ওরে মৃত্যু , জানি
তুই আমার বক্ষের মাঝে
               বেঁধেছিস বাসা ।
যেখানে নির্জন কুঞ্জে ফুটে আছে যত মোর
               স্নেহ-ভালোবাসা ,
গোপন মনের আশা ,     জীবনের দুঃখ সুখ ,
               মর্মের বেদনা ,
চিরদিবসের যত     হাসি-অশ্রু-চিহ্ন-আঁকা
               বাসনা-সাধনা ;
যেখানে নন্দন-ছায়ে নিঃশঙ্কে করিছে খেলা
               অন্তরের ধন ,
স্নেহের পুত্তলিগুলি , আজন্মের স্নেহস্মৃতি ,
               আনন্দকিরণ ;
কত আলো , কত
ছায়া , কত ক্ষুদ্র বিহঙ্গের
               গীতিময়ী ভাষা —
ওরে মৃত্যু , জানিয়াছি
, তারি মাঝখানে এসে
               বেঁধেছিস বাসা!
নিশিদিন    নিরন্তর    জগৎ     জুড়িয়া     খেলা ,
               জীবন চঞ্চল ।
চেয়ে    দেখি    রাজপথে   চলেছে   অশ্রান্তগতি
               যত পানথদল ;
রৌদ্রপাণ্ডু নীলাম্বরে    পাখিগুলি   উড়ে    যায়
               প্রাণপূর্ণ বেগে ,
সমীরকম্পিত     বনে     নিশিশেষে   নব    নব
               পুষ্প উঠে জেগে ;
চারি দিকে   কত শত   দেখাশোনা   আনাগোনা
               প্রভাতে   সন্ধ্যায় ;
দিনগুলি প্রতি প্রাতে      খুলিতেছে জীবনের
               নূতন অধ্যায় ;
তুমি শুধু এক প্রান্তে    বসে আছ অহর্নিশি
গগন ঢাকা ঘন মেঘে ,
পবন বহে খর বেগে ।
      অশনি ঝনঝন
      ধ্বনিছে ঘন ঘন ,
নদীতে ঢেউ উঠে জেগে ।
পবন বহে খর বেগে ।
তীরেতে তরুরাজি দোলে
আকুল মর্মর-রোলে ।
      চিকুর চিকিমিকে
      চকিয়া দিকে দিকে
তিমির চিরি যায় চলে ।
তীরেতে তরুরাজি দোলে ।
ঝরিছে বাদলের ধারা
বিরাম-বিশ্রামহারা ।
      বারেক থেমে আসে ,
      দ্বিগুণ উচ্ছ্বাসে
আবার পাগলের পারা
ঝরিছে বাদলের ধারা ।
মেঘেতে পথরেখা লীন ,
প্রহর তাই গতিহীন ।
      গগন-পানে চাই ,
      জানিতে নাহি পাই
গেছে কি নাহি গেছে দিন ;
প্রহর তাই গতিহীন ।
   ৮.দুর্বোধ 
তুমি মোরে পার না বুঝিতে ?
       প্রশান্ত বিষাদভরে
       দুটি আঁখি প্রশ্ন ক'রে
     অর্থ মোর চাহিছে
খুঁজিতে ,
চন্দ্রমা যেমন ভাবে স্থিরনতমুখে
      চেয়ে দেখে সমুদ্রের
বুকে ।
        কিছু আমি করি নি গোপন
।
           যাহা আছে সব আছে
            তোমার আঁখির কাছে
        প্রসারিত অবারিত মন ।
  দিয়েছি সমস্ত মোর করিতে ধারণা ,
        তাই মোরে বুঝিতে পার
না ?
        এ যদি হইত শুধু মণি ,
           শত খণ্ড করি তারে
           সযত্নে বিবিধাকারে
        একটি একটি করি গণি
  একখানি সূত্রে গাঁথি একখানি হার
        পরাতেম গলায় তোমার ।
        এ যদি হইত শুধু ফুল ,
           সুগোল সুন্দর ছোটো ,
           উষালোকে ফোটো-ফোটো ,
        বসন্তের পবনে দোদুল ,
  বৃন্ত হতে সযতনে আনিতাম তুলে —
        পরায়ে দিতেম কালো চুলে
।
 

 
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন