রবিবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০১২

শ্মশানবৈরাগ্য/ সমর কুমার সরকার / শিলিগুড়ি


‎[ তথ্য: বারাণসী ভ্রমণ কালে,বিজয়া দশমীর বিষণ্ণ সন্ধ্যায় আমি হরিশচন্দ্র ঘাট পরিদর্শনে গিয়াছিলাম। গঙ্গা তীরবর্তী ঘাট সংলগ্ন শ্মশানে,বেশ কয়েকটি শব,দাহের অপেক্ষায় বাঁশের মাচায় শায়িত ছিল। তিন চারিটি চিতা দাউ-দাউ করিয়া জ্বলিতেছিল। চারি দিকে পোড়া চিতা কাষ্ঠ ও চিতাভস্ম,তাহার মাঝে এখানে ওখানে মৃতের ব্যবহৃত পরিচ্ছদ,শয্যা,ফুল, মালা,বাঁশের টুকরা ইত্যাদি বিক্ষিপ্ত ভাবে ছড়াইয়া ছিল। শবের সৎকার দৃশ্য আমার মনে করুণ রসের সৃষ্টি করিয়াছিল। তদুপরি চিতার ধুমাগ্নি ও মৃত দেহ দাহের কটু গন্ধ আমার মনে শ্মশানবৈরাগ্যের সৃষ্টি করিয়াছিল। তখন আমার মনে যে অনুভূতির সৃষ্টি হইয়াছিল,তাহাই এস্থলে বর্ণিত হইল।]


শ্মশানবৈরাগ্য
***********

পুণ্যতোয়া গঙ্গা তীরে,দূরে নির্জনে,
দাউ-দাউ জ্বলে চিতা,এখানে ওখানে।
ভস্মীভূত চিতাভস্ম,সর্বত্র ছড়ায়ে -
ডোমেরা সাজায় চিতা শুষ্ক কাষ্ঠ দিয়ে।
শায়িত শবের সারি,সবে নিষ্প্রাণ,
শেষ আশ্রয় স্থল এ মহাশ্মশান।

ধূলিতে শয়ান সবে বাঁশের মাচায়,
চিরনিদ্রিত তাই ফিরিয়া না চায়।
চন্দন চর্চিত মুখে প্রাণহীন হাসি,
গলে ফুল মালা,জ্বলে ধূপ রাশি রাশি।
শোকাতুর পরিজন জানায় বিদায় ,
'বল হরি হরি বোল' রব দূরে ধায়।

এত দিন পরিচিত ছিল ধরাধামে,
দেশ,ধর্ম,জাতি ভেদে পদবী ও নামে।
ধন,মান,গুণ,দোষ,নানা পরিমাপে,
পরিচিত হয়েছিল ক্রমে ধাপে ধাপে।
একটি জীবন ঘিরি বাঁধা ছিল সব -
যাহার বিহনে আজি শুধু মাত্র শব।

অনিত্য যে নর দেহ তিলে তিলে গড়া,
সে তো শুধু হাড়,মাস,চর্বিতে ভরা।
হৃদযন্ত্র,পাকাশয়,রক্ত,শিরা-জাল,
কেশ,চর্মে সুশোভিত উলঙ্গ কঙ্কাল।
কেমনে তাহাতে সৃষ্ট হয়েছিল প্রাণ -
কোথা হতে এলো প্রাণ,কোথা গম্য স্থান ?

কত সুখে ছিল ওরা,মনে কত আশা,
কত মান,অভিমান,তৃপ্তি,হতাশা ।
সুখ ছিল,দুখ ছিল,ছিল কামানল,
প্রেম বা বিরহ ছিল,ছিল নানা ছল।
হৃদয় অসার আজি,অনুভূতি নাই,
ক্ষণিক প্রতীক্ষা মাত্র,পুড়ে হবে ছাই।

‘জন্মিলে মরিতে হবে’-নিশ্চিত জানি,
স্থিতিকাল ব্যাপ্ত ওরা ছিল অজ্ঞানী।
ধন চাই,মান চাই,চাই যে ক্ষমতা,
কামিনী,কাঞ্চন চাই,সর্ব সার্থকতা।
চাই,চাই,চাই শুধু,করেনি যাচাই,
কোথা হতে কেন আসি,কোথা ফিরে যাই।

শ্মশানবৈরাগ্য জাগে,দেখিতে যে পাই -
অনিত্য সংসারে কেহ আপনার নাই।
যারে জানি পিতা,মাতা,ভ্রাতা ও ভগিনী,
পুত্র,কন্যা,অর্ধাঙ্গিনী,প্রেম-প্রণয়িনী।
পুত্তলিকা সম সবে রঙ্গমঞ্চ পরে,
অলখিতে সঞ্চালিছে দক্ষ বাজীকরে।

সেই মায়া বলে এত নাম,পরিচয়,
কুশীলব যেন মিথ্যা করি অভিনয়।
জীবন নাটক শেষে পড়ে যবনিকা।
পালা ক্রমে যেতে হয় সবে একা একা।
কেন আসা,কেন যাওয়া,কেন এ ছলনা,
মিছে জাল বোনা ভবে,রহিল অজানা।

জীবন-তপন ঢলে অস্তাচল পানে,
'বেলা অবসান বুঝি'-ভীতি জাগে মনে।
ধন,মান,পরিজন,নহে আপনার,
জীবতরী পার হলে ভব পারাবার।
নশ্বর জীবনে সত্য স্থায়ী কিছু নাই,
জীবনের অবশেষ শব-দগ্ধ ছাই।

তবে কেন জন্ম লয়ে,ধরণীতে আসা?
এত কোলাহল,এত আশা,ভালবাসা।
এত সুখ,এত প্রাপ্তি,এত মুগ্ধতা,
জীবনের খেলাঘরে চির ব্যাকুলতা।
এত সুর,এত গান,স্বপ্ন মায়াজাল,
প্রাণহীন হলে দেহ সব পয়মাল।

কেন তিলে তিলে গড়া এই সভ্যতা,
অধিকার লয়ে দ্বন্দ্ব,বিজিত-বিজেতা।
স্বার্থের সংঘাত লয়ে কত না লড়াই,
আপন গরিমা জ্ঞানে মিথ্যা বড়াই।
অমর হইতে চাহ,রেখে যাও দাগ।
রহিবে তোমার স্মৃতি,প্রেম অনুরাগ।

জরা,ব্যাধি মৃত্যু হতে নাহি কারো পার,
বৃথা বহে চলা ব্যর্থ জীবনের ভার।
স্মরণীয় হবে যদি হও বরণীয়,
গরল গ্রাসিয়া দেহ প্রাণের অমিয়।
এমন আসিবে দিন,তুমি শুধু নাই।
প্রতি জনপদ গৃহে স্থায়ী তব ঠাঁই।

*************************
সমর কুমার সরকার / শিলিগুড়ি
*************************

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন