শনিবার, ৭ এপ্রিল, ২০১২



কাজী নজরুল ইসলাম :-
গণমানুষের কবি, সাম্যবাদী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবন হাজার রকম বৈচিত্র্যে ভরা। তার জীবনের নানা অংশ জুড়ে আষ্টে-পৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে বঞ্চনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ আর গণমানুষের অধিকার আদায়ের তীব্র আকাক্সক্ষা। ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষ তখন ইংরেজদের কুশাসনের দাবানলে পুড়ছিল। আর তাই কবি কাজী নজরুল ইসলামের সবচেয়ে বড় বৈরীপক্ষ ছিল ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী। সঙ্গত কারনেই ব্রিটিশদের সইতে পারতেন না নজরুল। অন্যায়ের বিপক্ষে- সত্যের পক্ষে ও শোষিত মানুষের জন্য কথা বলতে গিয়ে নজরুল ব্রিটিশ শাসকের রোষানলে পড়ে জেল পর্যন্ত খেটেছেন। শুধু তাই নয় নজরুলের লেখার ওপরও নিষেধাজ্ঞা জারি করে ব্রিটিশ সরকার। কাজী নজরুলের লেখা যুগবাণী, বিষের বাঁশি, ভাঙ্গার গান, প্রলয় শিখা ও চন্দ্রবিন্দুসহ মোট ৫টি গ্রন্থ ব্রিটিশ সরকার বাজেয়াপ্ত করে। বলা বাহুল্য বাংলা সাহিত্যে সমকালীন অন্য কোনো কবি বা সাহিত্যিকের এত গ্রন্থ একত্রে কখনও বাজেয়াপ্ত হয়নি। তাই নজরুলের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ রাজরোষের মাত্রা এখান থেকেই অনুমান করা যায়। নজরুলের প্রতিবাদ আর তাঁর লেখনীর অন্যতম দিক হলো নজরুলই ভারতবর্ষে প্রথমবারের মতো পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতার কথা উচ্চারণ করেন। নানা সৃষ্টিতে বৈচিত্র্যমণ্ডিত নজরুলের কর্মকান্ডের সঙ্গে যুক্ত হয় পত্রিকা সম্পাদনাও। ১৯২২ সালে নজরুল 'ধূমকেতু' নামের একটি পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করেন। পত্রিকাটি সপ্তাহে দু'বার প্রকাশ পেত। ১২ সেপ্টেম্বর ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ধূমকেতু'র দ্বাদশ সংখ্যায় 'আনন্দময়ীর আগমন' নামক একটি কবিতা প্রকাশিত হয়। কবিতাটি ব্রিটিশ শাসকদের ভিত কাঁপিয়ে দেয়। ফলে এই কবিতায় নজরুলের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম রাজদ্রোহের মামলা হয়। একই বছরের ৮ নভেম্বর রাজদ্রোহের অপরাধে নজরুলের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। দেশদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত নজরুলের বিচার হয়েছিল কলকাতার আলীপুর চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে। পরবর্তীতে এই মামলার রায়ে ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের ১০ জানুয়ারি নজরুল এক বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। রায় ঘোষণার পরের দিন তাকে আলীপুর সেন্ট্রাল জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আগে থেকেই নজরুলের কাব্য চেতনা আর সৃষ্টিশীল দ্রোহের সঙ্গে পরিচিত ছিল সাধারন মানুষ। এবার কারাবরণ করে নজরুল সমগ্র দেশবাসীর কাছে শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে ওঠেন। এমনকি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ নজরুলের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে তার 'বসন্ত' নাটকটি কবির নামে উৎসর্গ করেন। দিনটি ছিল ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের ২২ ফেব্রুয়ারি। এদিকে ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের ১৪ এপ্রিল নজরুলকে আলীপুর সেন্ট্রাল জেল থেকে হুগলী জেলে স্থানান্তর করা হয়। আলীপুরে নজরুল ছিলেন বিশেষ শ্রেণীর কয়েদি। কিন্তু হুগলিতে স্থানান্তরের পর নজরুলকে বিশেষ শ্রেণীর কয়েদির মর্যাদার পরিবর্তে সাধারণ শ্রেণীর কয়েদির অবস্থানে নামিয়ে দেওয়া হয়। হুগলী জেল সুপার মিস্টার আর্সটন ছিলেন নির্যাতন ও দুর্ব্যবহারের জন্য কুখ্যাত। বিশেষ করে রাজবন্দীদের সঙ্গে জেলের ভেতর অমানবিক নির্যাতন ও দুর্ব্যবহার করতেন তিনি। এ সময় নজরুল তার বিখ্যাত 'শিকল পরার গান' জেলে বসেই রচনা করেন। জেলখানার ভেতর অকথ্য নির্যাতন আর বৈষম্যের শিকার হয়ে নজরুল এখানেও বিদ্রোহী হয়ে ওঠলেন। শুরু করলেন আন্দোলন। আন্দোলনের সূত্র জেলখানায় পায়ে ডান্ডা বেড়ি, ভাতের বদলে মাড় ভাত ও রাজবন্দীদের নির্যাতনের প্রতিবাদ। এসব বন্ধের দাবিতে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের ১৪ এপ্রিল হুগলী জেলে অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। দিনের পর দিন তিনি অনশন চালিয়ে যেতে থাকেন।
সে সময়কার কবির জেল জীবন সম্পর্কে খুব পরিষ্কার ধারনা পাওয়া না গেলেও নজরুলের জেল জীবনের করুণ মর্মান্তিক চিত্র তুলে ধরে কলকাতার আনন্দবাজার ও দেশ পত্রিকা। সেখানে বিভিন্ন সময় প্রকাশিত একাধিক বিশ্লেষণী লেখায় নজরুলের সেই সময়কার অনশনসঙ্গীদের ভাষ্যে ফুটে ওঠে নজরুলের জেল জীবন। হুগলি জেলে কবি নজরুলের সঙ্গে মৌলভী সিরাজউদ্দীন এবং বাবু গোপাল চন্দ্র সেনও অনশনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। সেই সূত্র মতে অনশনের কয়েকদিনের মধ্যেই নজরুল প্রবল জ্বরে আক্রান্ত হন। সেই সঙ্গে অযত্ন অনাহারে শরীরের ওজন প্রায় ১৩ কেজি কমে যায়। এভাবে নজরুল একটানা অনশন করে যান ৩৯ দিন। আশে-পাশের শুভাকাক্সক্ষী ও সাধারন মানুষ নজরুলের পরিণতির কথা চিন্তা করে আঁতকে ওঠলেও নজরুল তার সিদ্ধান্তে ছিলেন অবিচল। সেই সময় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বয়ং নজরুলকে চিঠি লিখে অনশন ভঙ্গ করার অনুরোধ জানান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিলং থেকে এ বিষয়ে তাকে টেলিগ্রাম পাঠান। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন- 'Live up hunger strike. Our Literature claims you' কিন্তু টেলিগ্রামটি নজরুলের হাতে পৌঁছায়নি। জেল কর্তৃপক্ষ 'Address is not found' লিখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে টেলিগ্রামটি ফেরত পাঠান। জেল কর্তৃপক্ষ প্রকৃত ঠিকানা জানলেও ইচ্ছে করেই টেলিগ্রামটি নজরুলের কাছে না পাঠিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে ফেরত পাঠান। রবীন্দ্রনাথ এ ঘটনায় দারুণ মর্মাহত হন। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও নজরুলের অনশনে খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। তিনি শিবপুর থেকে ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের ১৭ মে হুগলী জেলে গিয়ে নজরুলের সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন। কিন্তু জেল কর্তৃপক্ষের অসহযোগিতা ও অনীহার কারণে তিনি দেখা করতে পারেননি। ফলে রবীন্দ্রনাথের চেয়েও বেশি হতাশ হতে হয়েছিল তাকে। চুরুলিয়া থেকে নজরুলের মা জাহেদা খাতুনও নজরুলের সঙ্গে দেখা করতে ব্যর্থ হন। এসব সংবাদ খুব দ্রুতই চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে সমগ্র দেশবাসী উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। অতঃপর শেষ পর্যন্ত অনশনের ৩৯ দিন পর কুমিল্লার মাতৃসম বিরজা সুন্দরী দেবীর অনুরোধে তারই হাতে লেবুর রস পান করে নজরুল অনশন ভঙ্গ করেন। তিনি ছিলেন কখনো রাজনীতিবিদ, কখনো কবি, ব্রিটিশদের কাছে তিনি ছিলেন এক প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। বার বার কারাভোগ করেছেন, নির্যাতিত হলেও আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি, পিছিয়ে আসেননি কখনই। লড়াই চালিয়ে গেছেন সারা জীবন। এরপর উপমহাদেশ ব্রিটিশ শাসনমুক্ত হলো। বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। জাতীয় কবির সম্মাণ দিয়ে নজরুলকে ঢাকায় আনা হলো। একসময় সমস্ত ভক্তদের কাঁদিয়ে কবি চলে গেলেন না ফেরার দেশে।
সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কাঁপা এক মহান পুরুষ। ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো চিরপ্রেমিক। দ্রোহ ও প্রেমের চিরবিদ্রোহী। তিনি কাজী নজরুল ইসলাম। বাঙালির জাগরণের কবি। বাংলা সাহিত্যের মুকুটহীন রাখালরাজা। বাংলাদেশের জাতীয় কবি। আজ ১১ জ্যৈষ্ঠ কবির জন্মদিন। ১১২তম জন্মবার্ষিকী।
এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি, আর বাকি হাতে রণ-তুর্য নিয়ে প্রেম ও দ্রোহের সম্মিলন ঘটাতে ১৩০৬ সালের ১১ জ্যৈষ্ঠ নিখিল ভারতের অবিভক্ত   বাংলার (বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ) বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন কবি নজরুল। বাবা কাজী ফকির আহমদ, মা জায়েদা খাতুন তার ডাক নাম রেখেছিলেন দুখুমিয়া। চুরুলিয়ার বালক দুখুর শৈশবের কিছু সময় কাটে বাংলাদেশে। ময়মনসিংহের ত্রিশালে দরিরামপুর স্কুলে লেখাপড়া করেন। কিছুদিন কাটান চট্টগ্রামে। বিয়ে করেন কুমিল্লায়। প্রথমে দৌলতপুরের নার্গিস। সে বিয়ে টেকেনি। পরে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন কুমিল্লার কান্দিরপাড়ের প্রমিলা সেনকে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাকরুদ্ধ অসুস্থ কবিকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দিয়ে জাতীয় কবির মর্যাদা দেন।
ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সার্বজনীন মুক্তি ও মানবতার কবি নজরুল বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির এক ক্ষণজন্মা প্রতিভা। বাংলা সাহিত্যাকাশে ধূমকেতু রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন তিনি। চিরপ্রেমিক চিরবিদ্রোহী কবি তার নাতিদীর্ঘ সাহিত্য সাধনার মাধ্যমে নিজকালের মাটি ও মানুষের জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে গেছেন বাংলাকাব্যকে। পরাধীন শৃক্সখলিত জাতির স্বাধীনতার স্পৃহাকে জাগ্রত করতে বিদ্রোহের গান শুনিয়েছেন এ ভূখণ্ডের আপামর জনসাধারণকে। 'কারার-ই লৌহ কপাট, ভেঙ্গে ফেল কর রে লোপাট, রক্ত জমাট শিকল পূজার পাষাণ বেদি। ওরে ও তরুণ ঈশান বাজা তোর প্রলয় বিষাণ, ধ্বংস নিষাণ, উড়ুক তারার প্রাচীর ভেদী'। বাঙালির ইতিহাস ঐতিহ্যের অহংবোধকে উত্তরসূরির মননে নাড়া দিতে নিজের লেখনী শক্তি দিয়ে বাজিয়েছেন আজন্ম প্রেমের মোহন বাঁশি_ 'তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয় সে কি মোর অপরাধ'?। কখনো গানে, কখনো বা কবিতায় বুনেছেন অসাম্প্রদায়িক চিন্তা চেতনার বীজ_ 'মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মসলমান' কবিতায়। অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে, মানবপ্রেমের পক্ষে আজীবন ছিলেন চিরজাগরুক তিনি। মানবকল্যাণ ও শান্তির চিরন্তন জয়গান গেয়েছেন আজীবন। মাত্র ২২ বছরের সাহিত্য জীবনে অসংখ্য কবিতা, গান, উপন্যাস, নাটক রচনার পাশাপাশি বেশ সম্পাদিত করেছেন বেশ কিছু পত্রিকা। ব্রিটিশ শাসনবিরোধী লেখার জন্য কয়েকবার কারারুদ্ধও হয়েছেন সাংবাদিক-কবি নজরুল ইসলাম। তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার তার কয়েকটি বইও নিষিদ্ধ করে। অজ্ঞাত রোগে বাকরুদ্ধ ও লেখনি শক্তি হারিয়ে অকালে সাহিত্যাকাশ থেকে ঝরে পড়ার আগে সৈনিক-কবি এভাবেই তার শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন করেছিলেন কাব্যলক্ষ্মীকে_'অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে/প্রদীপ শিখা সম/, কাঁপিছে প্রাণ মম/তোমার সুন্দর ভঙ্গিতে। ... /
আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে, এবং জাতির ক্রান্তিকালে সমস্যা সংকটের সময় সব বাধা অতিক্রমের প্রেরণা হয়ে আছেন কবি নজরুল। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে শক্তি ও সাহস যুগিয়েছিল তার লেখা কবিতা আর গান। এ বছর কবির অমরসৃষ্টি 'বিদ্রোহী' কবিতাটি রচনার ৯০ বছর পূর্তি হচ্ছে। ঔপনিবেশিকতার নাগপাশ থেকে দেশমাতৃকার মুক্তির লক্ষ্যে নিপীড়িত-নির্যাতিত-বঞ্চিতদের সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করতে কবির কলমের কালিতে অক্ষর আর শব্দের সম্মিলন ঘটেছিল যেন বিদ্রোহের আগুন। রচনা করেছিলেন কালজয়ী বিদ্রোহী_'বল বীর... / বল উন্নত মম শির।/ শির নেহারি আমারি নত শির ঐ শিখর হিমাদ্রির!/বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাঁড়ি/চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি/ ভূলোক, দূ্যলোক, গোলক ভেদিয়া,/ খোদার আসন আরস ছেদিয়া /উঠিয়াছে চির-বিস্ময়, আমি বিশ্ব বিধাত্রির!/মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে/ রাজ রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর!/বল বীর/আমি চির-উন্নত শির!'।
আজ জন্মদিনে কবির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছে জাতি। রাষ্ট্রীয় আচার অনুষ্ঠানে পালন করা হচ্ছে ১১২তম জন্মবার্ষিকী। সকালে ফুলে ফুলে ছেয়ে যাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ প্রাঙ্গণে কবির মাজার। আয়োজন করা হয়েছে তিন দিনব্যাপী রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান মালার। সকালে জাতীয় কবির স্মৃতিবিজড়িত ত্রিশালে নজরুল মেলার উদ্বোধন করবেন রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান। এ উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া পৃথক বাণীতে কবির অমর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানান। নানা কর্মসূচির মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, নজরুল ইনস্টিটিউট, নজরুল একাডেমী, বাংলা একাডেমী, শিল্পকলা একাডেমীসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন দিবসটি পালন করছে। গণমাধ্যমও দিনটি উপলক্ষে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ ও অনুষ্ঠান প্রচার করছে।
সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কাঁপা এক মহান পুরুষ। ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো চিরপ্রেমিক। দ্রোহ ও প্রেমের চিরবিদ্রোহী। তিনি কাজী নজরুল ইসলাম। বাঙালির জাগরণের কবি। বাংলা সাহিত্যের মুকুটহীন রাখালরাজা। বাংলাদেশের জাতীয় কবি। আজ ১১ জ্যৈষ্ঠ কবির জন্মদিন। ১১২তম জন্মবার্ষিকী।
এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি, আর বাকি হাতে রণ-তুর্য নিয়ে প্রেম ও দ্রোহের সম্মিলন ঘটাতে ১৩০৬ সালের ১১ জ্যৈষ্ঠ নিখিল ভারতের অবিভক্ত   বাংলার (বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ) বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন কবি নজরুল। বাবা কাজী ফকির আহমদ, মা জায়েদা খাতুন তার ডাক নাম রেখেছিলেন দুখুমিয়া। চুরুলিয়ার বালক দুখুর শৈশবের কিছু সময় কাটে বাংলাদেশে। ময়মনসিংহের ত্রিশালে দরিরামপুর স্কুলে লেখাপড়া করেন। কিছুদিন কাটান চট্টগ্রামে। বিয়ে করেন কুমিল্লায়। প্রথমে দৌলতপুরের নার্গিস। সে বিয়ে টেকেনি। পরে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন কুমিল্লার কান্দিরপাড়ের প্রমিলা সেনকে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাকরুদ্ধ অসুস্থ কবিকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দিয়ে জাতীয় কবির মর্যাদা দেন।
ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সার্বজনীন মুক্তি ও মানবতার কবি নজরুল বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির এক ক্ষণজন্মা প্রতিভা। বাংলা সাহিত্যাকাশে ধূমকেতু রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন তিনি। চিরপ্রেমিক চিরবিদ্রোহী কবি তার নাতিদীর্ঘ সাহিত্য সাধনার মাধ্যমে নিজকালের মাটি ও মানুষের জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে গেছেন বাংলাকাব্যকে। পরাধীন শৃক্সখলিত জাতির স্বাধীনতার স্পৃহাকে জাগ্রত করতে বিদ্রোহের গান শুনিয়েছেন এ ভূখণ্ডের আপামর জনসাধারণকে। 'কারার-ই লৌহ কপাট, ভেঙ্গে ফেল কর রে লোপাট, রক্ত জমাট শিকল পূজার পাষাণ বেদি। ওরে ও তরুণ ঈশান বাজা তোর প্রলয় বিষাণ, ধ্বংস নিষাণ, উড়ুক তারার প্রাচীর ভেদী'। বাঙালির ইতিহাস ঐতিহ্যের অহংবোধকে উত্তরসূরির মননে নাড়া দিতে নিজের লেখনী শক্তি দিয়ে বাজিয়েছেন আজন্ম প্রেমের মোহন বাঁশি_ 'তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয় সে কি মোর অপরাধ'?। কখনো গানে, কখনো বা কবিতায় বুনেছেন অসাম্প্রদায়িক চিন্তা চেতনার বীজ_ 'মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মসলমান' কবিতায়। অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে, মানবপ্রেমের পক্ষে আজীবন ছিলেন চিরজাগরুক তিনি। মানবকল্যাণ ও শান্তির চিরন্তন জয়গান গেয়েছেন আজীবন। মাত্র ২২ বছরের সাহিত্য জীবনে অসংখ্য কবিতা, গান, উপন্যাস, নাটক রচনার পাশাপাশি বেশ সম্পাদিত করেছেন বেশ কিছু পত্রিকা। ব্রিটিশ শাসনবিরোধী লেখার জন্য কয়েকবার কারারুদ্ধও হয়েছেন সাংবাদিক-কবি নজরুল ইসলাম। তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার তার কয়েকটি বইও নিষিদ্ধ করে। অজ্ঞাত রোগে বাকরুদ্ধ ও লেখনি শক্তি হারিয়ে অকালে সাহিত্যাকাশ থেকে ঝরে পড়ার আগে সৈনিক-কবি এভাবেই তার শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন করেছিলেন কাব্যলক্ষ্মীকে_'অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে/প্রদীপ শিখা সম/, কাঁপিছে প্রাণ মম/তোমার সুন্দর ভঙ্গিতে। ... /
আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে, এবং জাতির ক্রান্তিকালে সমস্যা সংকটের সময় সব বাধা অতিক্রমের প্রেরণা হয়ে আছেন কবি নজরুল। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে শক্তি ও সাহস যুগিয়েছিল তার লেখা কবিতা আর গান। এ বছর কবির অমরসৃষ্টি 'বিদ্রোহী' কবিতাটি রচনার ৯০ বছর পূর্তি হচ্ছে। ঔপনিবেশিকতার নাগপাশ থেকে দেশমাতৃকার মুক্তির লক্ষ্যে নিপীড়িত-নির্যাতিত-বঞ্চিতদের সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করতে কবির কলমের কালিতে অক্ষর আর শব্দের সম্মিলন ঘটেছিল যেন বিদ্রোহের আগুন। রচনা করেছিলেন কালজয়ী বিদ্রোহী_'বল বীর... / বল উন্নত মম শির।/ শির নেহারি আমারি নত শির ঐ শিখর হিমাদ্রির!/বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাঁড়ি/চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি/ ভূলোক, দূ্যলোক, গোলক ভেদিয়া,/ খোদার আসন আরস ছেদিয়া /উঠিয়াছে চির-বিস্ময়, আমি বিশ্ব বিধাত্রির!/মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে/ রাজ রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর!/বল বীর/আমি চির-উন্নত শির!'।
আজ জন্মদিনে কবির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছে জাতি। রাষ্ট্রীয় আচার অনুষ্ঠানে পালন করা হচ্ছে ১১২তম জন্মবার্ষিকী। সকালে ফুলে ফুলে ছেয়ে যাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ প্রাঙ্গণে কবির মাজার। আয়োজন করা হয়েছে তিন দিনব্যাপী রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান মালার। সকালে জাতীয় কবির স্মৃতিবিজড়িত ত্রিশালে নজরুল মেলার উদ্বোধন করবেন রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান। এ উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া পৃথক বাণীতে কবির অমর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানান। নানা কর্মসূচির মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, নজরুল ইনস্টিটিউট, নজরুল একাডেমী, বাংলা একাডেমী, শিল্পকলা একাডেমীসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন দিবসটি পালন করছে। গণমাধ্যমও দিনটি উপলক্ষে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ ও অনুষ্ঠান প্রচার করছে।

1 টি মন্তব্য:

  1. যখন আমি হারিয়ে যাব, বুঝবে সেদিন বুঝবে ।
    অস্তপারের সন্ধ্যাতারায় আমার খবর পুছবে –
    বুঝবে সেদিন বুঝবে । ............
    “অভিশাপ” কবিতায় লেখা কবির এই ছত্রগুলো কি সত্যি আমাদের প্রতি কবির অভিশাপ বানী ? নাকি আপন জনের প্রতি তীব্র অভিমানবোধ ? একটা গোলাপ যখন তার শেষ গন্ধটা বিলিয়ে দিয়ে পাপড়িগুলো ঝরিয়ে দেবার উপক্রম করে, তখন সে কি এমনই এক অভিশাপ মেশানো সতর্কবাণী রেখে যায় গাছটার জন্য ? যাতে গাছটা ভূ-লুন্ঠিত গোলাপের পাপড়িগুলোকে দেখে তার শেষ গন্ধটা বাতাসে খুঁজে নেবার চেষ্টা করে ? রূপ, রস আর গন্ধ ভরা ফুলটাকে স্মৃতিপটে সদা-উদ্ভাসিত রাখার প্রয়াস পায় ?
    এ কথা সত্যি যে, নজরুল আজ হারিয়ে গেছেন । কিন্তু এই অন্তর্ধান নিছকই এক বাহ্য ও আবশ্যিক প্রাকৃতিক পরিণতি । নজরুলের কায়া হারিয়েছে মাত্র, ছায়া নয় । নজরুল হারিয়েছেন প্রকৃতির পশ্চাৎপট থেকে, আমাদের বাঙ্গালিদেরে হৃদয়ের পশ্চাৎপট থেকে নয়।
    তাই নজরুলের খবর জানার জন্য সুদূর অস্তপারের সন্ধ্যাতারার কাছে যেতে হবে না । তাঁর হিমালয়-সদৃশ সু-উচ্চ কাব্য ও সাহিত্যপ্রতিভা, মহাসাগরের মত সুগভীর আত্মপ্রত্যয় আর দেশাত্মবোধ এবং মানবতাবোধের অপূর্ব অবিনশ্বর কীর্তিগুলির সঠিক অনুধাবনই আমাদের পৌঁছে দেবে নজরুলের সঠিক ঠিকানায় ।

    উত্তরমুছুন